ফ্লোর ক্রসিং বা দলত্যাগ কিঃ

সংবিধানের দলত্যাগের বিধান সম্বলিত ৭০ নং অনুচ্ছেদনামাঃ
------------------------------------------------------------------------
ফ্লোর ক্রসিং বা দলত্যাগ কিঃ
ফ্লোর ক্রসিং শব্দটি মূলত এসেছে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে যেখানে ট্রেজারি এবং অপজিশন বেঞ্চের সদস্যরা ফ্লোরের বিপরীত দিকে বসেন। নিজ সংসদীয় দলের বিপক্ষ দলকে সমর্থন করা থেকেই ফ্লোর অতিক্রম করার ব্যাপারটি এসেছে। ফ্লোর ক্রসিং প্রধানত: দুভাবে হতে পারেঃ
(১) বিপক্ষ দলে সরাসরি যোগ দিয়ে অথবা
(২) কোন বিলে বিপক্ষ দলকে সমর্থন দানের মাধ্যমে।
ফ্লোর ক্রসিংয়ের ব্যাপারে সম্ভবত: সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি উইনস্টন চার্চিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এখনো ফ্লোর ক্রসিংয়ের ঘটনা ঘটে কেননা তাতে সদস্যদের নির্বাচনী আসন হারানোর ঝুকি নেই। টনি ব্লেয়ারের আমলে তার লেবার পার্টির আনা বিলের বিরূদ্ধে ভোট দিয়ে বিলকে আইনে পরিণত হওয়া ঠেকিয়ে দিয়েছিল নিজ দলীয় সংসদ সদস্যরা।
বাংলাদেশের সংবিধানে কেন এটি সংযুক্ত করা হয়ঃ
পাকিস্তান আমলের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদকে একাধিকবার দলত্যাগের কারণে অস্থিতিশীলতার করুণ শিকারে পরিণত হতে হয়েছে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার একাধিকবার ভেঙে গিয়েছে এই দলত্যাগের কারণে। এমনকি ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীর মৃত্যুও ঘটেছিল সংসদ সদস্যদের মারামারিতে। সেই আমলের সংসদ সদস্যদের ঘন ঘন দল পরিবর্তনের কারণে সরকার পতন অথবা সরকার পুনর্গঠনের যে অস্থিরতা ছিল, তা থেকে রেহাই পেতেই বঙ্গবন্ধুর সমর্থন বা তাঁরই পরামর্শক্রমে সংবিধানে এই ৭০ অনুচ্ছেদের সংযোজন করা হয়।
বিভিন্ন দেশের সংবিধানে এই বিধানঃ
১) ভারতের সংবিধান মোতাবেক কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য যেসব কারণে রাজ্যসভা বা লোকসভার সদস্যপদে বহাল থাকার অযোগ্য হবেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- (ক) স্বেচ্ছায় দলের সদস্যপদ ত্যাগ; অথবা (খ) দলের নির্দেশ উপেক্ষা করে ভোটদান বা দলের অনুমতি ব্যতিরেকে ভোটদানে বিরত থাকা।
২) পাকিস্তানে একজন পার্লামেন্ট সদস্য তার পদে বহাল থাকার অযোগ্য হবেন যদি তিনি নির্বাচনে মনোনয়ন দানকারী দল থেকে পদত্যাগ করেন, অথবা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে, অথবা আস্থা বা অনাস্থা প্রস্তাবে, অথবা অর্থ বিল পাসে, অথবা সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবে দলের নির্দেশ অমান্য করে ভোট দেন অথবা ভোটদানে বিরত থাকেন।
৩) নেপাল প্রজাতন্ত্রের সংবিধান মোতাবেক কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে নির্বাচিত ফেডারেল পার্লামেন্টের একজন সদস্য তার আসন হারাবেন, যদি তিনি দলত্যাগ করেছেন মর্মে সংশ্লিষ্ট দল বিজ্ঞপ্তি জারি করে।
বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ নং অনুচ্ছেদ এর বিধানঃ
বাংলাদেশের সংবিধানে কী বলা হয়েছে এই অনুচ্ছেদে, দেখা যাকঃ 'কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী রূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-
(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।
৭০ অনুচ্ছেদ এর বিপক্ষে যুক্তিঃ
১। কোন সংসদ সদস্য ফ্লোর ক্রস করলে তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। এতে করে সংসদ সদস্যরা দলীয় লেজুড় বৃত্তিতে বাধ্য হচ্ছেন। আইনপ্রণেতা (Legislator) হিসেবে তাদের সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে।
২। অনুচ্ছেদ ৭০ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটি সংসদ সদস্যদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে।
৩।অনুচ্ছেদটি ভোটারদের স্বার্থরক্ষায় সংসদ সদস্যদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছে।
৭০ অনুচ্ছেদ এর পক্ষে যুক্তিঃ
১। সংসদীয় সরকার পদ্ধতিকে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করার জন্য সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭০ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২।দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করতে হবে।
৩। ৫২ অনুচ্ছেদের (৪) দফায় রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করার এবং ৫৭ অনুচ্ছেদের (২) দফায় প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য থাকার বিধানের উল্লেখ রয়েছে। ৫২(৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে যদি মোট সদস্য-সংখ্যার অনূ্যন দুই-তৃতীয়াংশ ভোট রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি অপসারিত হবেন। অন্যদিকে ৫৭(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন যদি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে না থাকে, তাহলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগে বাধ্য থাকবেন। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর তথা সংসদের স্থিতিশীলতা রক্ষার্থেও তাই এই ৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না।
৪। দেশে গণতন্ত্র, বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্র এখনও পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি। সংসদ সদস্যদের ভোটদানে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা কিছুটা খর্ব না করা হলে এবং দলীয় নির্দেশাবলী উপেক্ষার কারণে তাদের আসন শূন্য ঘোষিত হওয়ার বিধান না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।
৭০ নং অনুচ্ছেদের কিছু মতামতঃ
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ বিলোপ করা না হলেও এটির কিছু সংশোধন করা যেতে পারে । কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ভোটদানের ‘অপশন’ সংসদ সদস্যদের ইচ্ছাধীন করা যেতে পারে। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে-
ক. যখন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তখন সংসদ সদস্যরা তাদের নিজ নিজ দলের অবস্থানের বিপরীতে ভোট দিতে পারবেন না;
খ. সংসদে অর্থ বিল পাসের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা ভোটদানে নিজ নিজ দলের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করতে পারবেন না;
গ. সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিলে সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ দলের অবস্থানের বিপরীতে ভোট দিতে পারবেন না;
ঘ. স্পর্শকাতর প্রতিরক্ষা বিষয়ে বা অন্য কোনো বিষয়ে অনুষ্ঠিত সংসদের গোপন বৈঠকে সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ দলের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করতে পারবেন না।
এসব বিষয়ে দলের নির্দেশ অমান্য করে দলীয় অবস্থানের বিপক্ষে ভোট দিলে অথবা সংসদে উপস্থিত থেকে ভোটদানে বিরত থাকলে, অথবা সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত না থাকলে তিনি ওই দলের বিপক্ষে ভোটদান করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং সংসদে তার আসন শূন্য হবে। অন্য সব ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা ভোটদানে স্বাধীনতা ভোগ করবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে এরূপ সংশোধনী আনা যেতে পারে। এতে সংসদীয় গণতন্ত্র স্থিতিশীল ও শক্তিশালী হবে।
★কোন সাজেশান থাকলে কমেন্টে জানাবেন।
সূত্রঃ বিভিন্ন গণমাধ্যম,ব্লগ,সাংবিধানিক রাজনীতির বই থেকে সংগৃহীত, সম্পাদিত ,সংক্ষেপিত একটি মৌলিক লেখা।কপি করলে কার্টেসি দিতে ভুলবেন না ।
মুহাম্মদ ইরফান উদ্দীন
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা(সুপারিশপ্রাপ্ত)
৩৭ তম বিসিএস নন-ক্যাডার

No comments:

Post a Comment