Showing posts with label ইতিহাস. Show all posts
Showing posts with label ইতিহাস. Show all posts

৭১-এ যশোর মুক্তিযুদ্ধের এক অকথিত অধ্যায় - শামসুর রহমান

৭১-এ যশোর মুক্তিযুদ্ধের এক অকথিত অধ্যায় | শামসুর রহমান সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৪ 

৬ ডিসেম্বর: হানাদারমুক্ত হয় যশোর



১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে থেকে দখলদার পাকবাহিনী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত শক্তি সশস্ত্র লড়াই-এ অবতীর্ণ হয়, পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) তাদের অন্যতম। দেশের বিভিন্ন এলাকায় পার্টি নেতৃত্বে গঠিত হয় সেনাবাহিনী। যারা দীর্ঘ নয় মাস বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে দখলকার বাহিনীর পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাদের এ অবদানকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল) বা ইপিসিপি (এম এল)-এর এই প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাসে যশোর জেলা একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এখানে পার্টির সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন মুক্ত রাখতে সক্ষম হয় বিশাল এলাকা কৃষকের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যে এ মুক্ত অঞ্চলকে ঘোষণা দেয়া হয় কৃষক রাজের এলাকা হিসেবে। কিন্তু পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভুল রাজনৈতিক লাইনের কারণে এ যুদ্ধের ফলাফল এক করুণ পরিণতির মধ্যদিয়ে পার্টির বিপর্যয় ডেকে আনে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেই যশোরের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও তাদের কর্মীরা ভারতে চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত থেকে আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ইপিসিপি (এম এল)-এর নেতৃত্বে দীর্ঘ আট মাস পার্টি বাহিনী জনগণকে রক্ষা করে। এর অসীম সাহসী যোদ্ধারা বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধ করতে থাকে দখলদার বাহিনীকে। শহীদ হন অগণিত কর্মী। পার্টির এই ভূমিকা জনগণের কাছে তাদেরকে সেদিন আরও আস্থাশীল করে তুলেছিল। বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো অজস্র লোক এসে সমবেত হয়েছিল পার্টির পতাকা তলে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে তাদের এ অবদানের স্বীকৃতি দিতে অনেকে কুন্ঠিত। বরং দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মহলে তাদের যুদ্ধকালীন ভূমিকা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শোনা যায়। তাদের প্রকৃত অবদান ও ভূমিকা অন্বেষণে এ প্রতিবেদক ব্যাপক অনুসন্ধান চালান। তারই ফলশ্রুতি এ প্রতিবেদন। ইপিসিপি (এম এল) স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের ভূমিকা সম্পর্কিত কোন ইতিহাস সংগ্রহ করেনি। 

তবে পার্টির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র গোপনে প্রকাশিত জনযুদ্ধ পত্রিকার প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় (আগস্ট ১৯৭২) এ সম্পর্কিত একটি পর্যালোচনামূলক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদন তৈরিতে পর্যালোচনা রিপোর্টের সাহায্য নেয়া হয়েছে। ঐ রিপোর্টে যুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলীর সামান্য ছায়া পাওয়া যায় না। রিপোর্টটি অবলম্বন করে পার্টির তৎকালীন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিকে প্রতিবেদনটি তৈরি। এটি পূর্ণাঙ্গ তথ্যভিত্তিক ইতিহাস নয় কিংবা ঘটনার বিশ্লেষণও নয় শুধুমাত্র কালপঞ্জী অনুসারে ঘটনার গ্রন্থনা মাত্র। ‘জনযু্দ্ধ’-এর পর্যালোচনামূলক রিপোর্টটি তৈরি করেন পার্টির যশোর জেলা কমিটির অন্যতম নেতা ‘কমরেড পার্থ ওরফে কমরেড ইন্দ্র’ এবং কমরেড রঘু ওরফে কমরেড রশীদ।’ ‘কমরেড পার্থ’ হলেন যশোর এম এম কলেজ ছাত্র সংসদের প্রাক্তন ভিপি ’৬৩ সালে ছাত্র ইউনিয়ন-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জনাব নুর মোহাম্মদ। ‘কমরেড রঘু’ বর্তমানে বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা নড়াইলের বিমল বিশ্বাস। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সময় পার্টির যশোর জেলা কমিটির সম্পাদক ছিলেন শালিখা থানার পুলুম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও ঘোষগাঁতী গ্রামের প্রখ্যাত কবি হাবিবুর রহমানের পুত্র শামসুর রহমান। জেলা কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সুধাংশ দে, হেমন্ত সরকার, মহিউদ্দীন আলী আকতার, বিমল বিশ্বাস, ‍নূর মোহাম্মদ খবিরউদ্দীন। এ সময় জেলা শালিখা, লোহাগড়া, কালিয়া, নড়াইল, অভয়নগর, বাঘারপাড়া, মোহাম্মদপুর, কালীগঞ্জ, কোতোয়ালী, মনিরামপুর, কেশবপুর, ঝিকরগাছা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, হরিণাকুন্ডু, শৈলকুপা, কোটচাঁদপুর প্রভৃতি থানায় পার্টির সংগঠন তৈরি হয়েছে। 

তবে গোপন রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কর্মী ছাড়া ব্যাপক জনগণকে সব এলাকায় পার্টির পতাকাতলে আনা সম্ভব হয়নি। জেলা ও আঞ্চলিক নেতৃত্বের অধিকাংশ থাকতেন আন্ডারগ্রাউন্ডে। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন ২২শে মার্চ পার্টির যশোর জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সভা বসে। এতে নেতৃবৃন্দ ‘যেখানে সম্ভব সেখানে স্বাধীন বাংলার বিপরীত চিত্র হিসেবে জনগণতান্ত্রিক বাংলার পতাকা তুলে ধরতে হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।’ জনযুদ্ধ-এর পর্যালোচনা রিপোর্টে বলা হয় এই সিদ্ধান্ত ছিল খানিকটা গোঁজামিল এবং এই সিদ্ধান্তের তাৎপর্য ও কর্মীদের কাছে সঠিকভাবে হাজির হতে পারেনি। তবে বৈঠকে বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটিকে প্রতিরোধ বাহিনী গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। ২৬শে মার্চ বাঙালীদের উপর পাকবাহিনীর সশস্ত্র হামলার ফলে জেলার বিভিন্ন এলাকার মধ্যে স্বাভাবিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদিও যশোর শহরের পতন ঘটে দেরীতে তবু পার্টি তার সদস্য ও কর্মীদের বর্তমান অবস্থায় কি করণীয় সে নির্দেশ দিতে পারেনি। পার্টির কয়েকটি আঞ্চলিক কমিটি স্থানীয় জনগণের সহায়তায় ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সমন্বয়ে জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধের জন্যে প্রস্তুত হতে থাকে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকগণ, বাঙালী ইপিআর ও আনসাররা যশোর থেকে পিছিয়ে আসার সময় বহু আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ স্থানীয় এসব প্রতিরোধ বাহিনীকে দিয়ে যায়। কয়েকটি স্থানে ট্রেজারী ও অস্ত্রখানা লুট করা হয়। পার্টি সদস্যগণ এতে সক্রিয় ভূমিকা নেন। এই সব গোলাবারুদ ও অস্ত্রের একটি অংশ পার্টি সদস্যদের হাতে আসে। ইতিমধ্যে জেলার বিভিন্ন এলাকায় অবাঙালী ও পাকবাহিনীর এদেশীয় দোসররা লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। পার্টির সশস্ত্র কর্মীরা তা মোকাবেলা করতে জনগণের পাশে এসে দাঁড়ান। ১১ই এপ্রিল জেলা কমিটির বৈঠক বসে। বৈঠকে ‘শ্রেণী শত্রু খতম দ্রুততর করা ও সম্ভাব্য অঞ্চল নিয়ে মুক্ত এলাকা গঠনের আহ্বান জানানো হয়।’ এ বৈঠকের পর পরই পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মাত্রা তীব্রভাবে বেড়ে যায়। সাম্প্রদায়িকতা ভিত্তিক লুটতরাজে দখলদার বাহিনী ও তার এদেশীয় দোসসরা ভূমিহীন গরীব মুসলিম জনতার একাংশকে অংশগ্রহণ করাতে সক্ষম হয়।  

শহীদ মাশুকুর রহমান (তোজো) তখন ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স-এ কর্মরত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংকে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন যান। যশোরের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি ও বিখ্যাত আইনজীবী হবিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র মাশুকুর রহমান (৩০) ’৭১ সালে ইপিসিপি (এম এল)-এ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। শহীদ হন ২৩ অক্টোবর। শহীদ আসাদ-উজ্জামান (২২) ছিলেন যশোর জেলার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক এবং যশোর এম এম কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি। ব্যক্তিগত জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ছোট ভাই। ’৭১ সালে ইপিসিপি (এম এল)-এর প্রার্থী সদস্য ছিলেন। এম এম কলেজ ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শহীদ নজরুল ইসলাম (২২) ’৭১ সালে ইপিসিপি (এম এল)-এর পূর্ণ সদস্য ছিলেন। পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে ছাত্র ও কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ০০০ যশোরের মনিরামপুর, অভয়নগর, কেশবপুর, কোতোয়ালী, বাঘারপাড়া প্রভৃতি এলাকার হিন্দু সম্প্রদায় লুটপাটের শিকার হন সব থেকে বেশি। পাকবাহিনীর এই চরম নৃশংসতার মুখে অসহায় জনতাকে ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভারতে পাড়ি জমান। বিচ্ছিন্নভাবে ইপিসিপি (এম এল)-এর সদস্য ও কর্মীরা তখন এদেরকে মোকাবেলা করতে থাকেন। সশস্ত্র দুস্কৃতকারীদের প্রতিরোধ করতে হয় সশস্ত্রভাবে। এর ফলে ইপিসিপি (এম এল)-এর সুনাম বেড়ে যায়। 

ভারতে যাননি অথচ দেশের অভ্যন্তরে আছেন—এমন ধরনের বহু শিক্ষিত অশিক্ষিত যুবক ও বুদ্ধিজীবী পার্টিতে আসতে থাকেন। পার্টি সদস্যরা এ সমস্ত শক্তি নিয়ে এপ্রিল মাসে বিচ্ছিন্নভাবে সশস্ত্র স্কোয়াড তৈরিতে মনোযোগী হন। সশস্ত্র স্কোয়াড সংখ্যা বেড়ে গিয়ে তৈরি হয় স্থানীয় সশস্ত্র বাহিনী। যশোর জেলার নড়াইল, লোহাগড়া, শালিখা, মাগুরা, মোহাম্মদপুর, কালীগঞ্জ, বাঘারপাড়া, অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর, কোতোয়ালী ও ঝিকরগাছা থানার বিস্তীর্ণ এলাকায় এই বাহিনী শত্রুর মোকাবেলা করতে থাকে। বিশেষ করে এখানকার পুলুম, নারিকেলবাড়িয়া, খাজুরা, লাহুড়িয়া, সরসুন, গোবরা, পেড়েলী, মুলিয়া, এগারখান প্রভৃতি এলাকায় পার্টি ঘাঁটি স্থাপনে সক্ষম হয়। বুদ্ধিজীবী সদস্যরা এ পর্যায়ে ইপিসিপি (এম এল)-এর নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে যায়। পার্টির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার ওপর দিয়েই চলে গিয়েছিল ভারতে যাবার কয়েকটি রুট। এ সময় যশোর ছাড়াও খুলনা, ফরিদপুর ও বরিশাল জেলার হাজার হাজার শরণার্থী ভারতে চলে যেতে থাকে। ইপিসিপি (এম এল) কর্মীর তাদের নিরাপদে সীমান্ত অতিক্রমের যাবতীয় ব্যবস্থা নেন। এর ফলে লুটপাটকারীদের কবল থেকে শরণার্থীরা রক্ষা পায়। দখলদার বাহিনীর অত্যাচার মোকাবিলায় একমাত্র শক্তি হিসেবে ইপিসিপি (এম এল)-এর অভ্যূদয় পার্টির প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এ সময় গঠিত শক্তিশালী প্রতিরোধ বাহিনীর মধ্যে লোহাগড়া ও পেড়েলী ছাড়াও নড়াইলের গোবরা এবং বাঘারপাড়ার বাহিনী জনগণের কাছে অত্যন্ত আস্থাশীল হয়ে ওঠে। গোবরা এলাকার বাহিনী গড়ে ওঠে জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য বিমল বিশ্বাসের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এই সশস্ত্র বাহিনীটি বিস্তীর্ণ এলাকায় লুটপাটকারীদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাহিনী যতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে ততই কমে আসে শান্তি কমিটির হামলা। নারিকেলবাড়িয়া এলাকাতে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে ওঠে মোশারেফ হোসেন মুশা ও বিশ্বনাথের নেতৃত্বে। 

তারা ছিলেন পার্টি সদস্য। মুশা একজন একজন প্রাক্তন মুজাহিদ। জেলা নেতৃত্বের তত্বাবধানে অল্প সময়ের মধ্যে এ বাহিনীর সশস্ত্র সদস্য সংখ্যা বেড়ে যায়। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন প্রাক্তন মুজাহিদ ও আনসার বাহিনীর সদস্য। তারা শালিখা থানা আক্রমণ করে এবং সমস্ত পুলিশ আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। থানার অস্ত্রও চলে আসে ইপিসিপি (এম এল)-এর হাতে। এ অস্ত্র দিয়ে সশস্ত্র বাহিনী সম্প্রসারণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলে। বাঘারপাড়া, শালিখা এবং কালীগঞ্জ থানার বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর পার্টি বাহিনীর কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। এপ্রিল মাসেই জেলা কমিটির রাজনৈতিক দফতর হিসেবে শালিখার পুলুশ এলাকা বেছে নেয়া হয়। পার্টির সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক সদর দফতরও স্থাপন করা হয় পুলুমে। প্রাকৃতিক দিক থেকে পুলুমের অবস্থান ছিল সদর দফতর স্থাপনের দারুণ উপযুক্ত। যশোর শহর থেকে এর দূরত্ব ৩০ মাইল উত্তর-পূর্বে। নড়াইলের প্রায় ১২ মাইল উত্তরে। আবার মাওয়ার ১৮ মাইল দক্ষিণে। চিত্রা নদীর একেবারে পূর্বপ্রান্তে পুলুম যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হেঁটে এখানে পৌঁছানো ছাড়া গাড়িতে যাতায়াতের উপায় ছিলো না। এই এলাকায় উত্তরপ্রান্ত থেকে চলে গেছে ফটকী নদী। মোটামুটি এ ঘাঁটি থেকে বাইরে সফল গেরিলা যুদ্ধ পরিচালান করা যায়। তেমনি শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যেও এটি ছিলো উপযুক্ত স্থান। 

১৪ জুন বসে জেলা কমিটির বৈঠক। এতে শ্রেণীশত্রু, মিলিটারী, রাজাকার, তখনও কার্যরত থানাসহ প্রশাসনিক ব্যবস্থা দালাল ইত্যাদির বিরুদ্ধে আক্রমণ অভিযান দ্রুততর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাশাপাশি ব্যাপক অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধকে ছড়িয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট অঞ্চলে ক্ষমতা সংহত করার আওয়াজ সামনে রেখে কতিপয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। 

১। ‘প্রয়োজনীয় শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমতা দখলের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী কমিটি গঠন করা। এখানে এটা অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার যে, এই সিদ্ধান্ত নেবার আগেই পার্টির নেতৃত্বে অসংগঠিত জন-ক্ষমতার ব্যবহার হতে থাকে।’ 

২। ‘গেরিলা যুদ্ধের মধ্যদিয়ে নিয়মিত ও স্থানীয় বাহিনী গঠন করার প্রস্তুতি নেয়া। ভূমিহীন-গরীব কৃষকদের নিয়ে জনে জনে চক্রান্তমূলভাবে গোপনে শ্রেণী শত্রুদের খতম অভিযানের জায়গায় ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের নেতৃত্বে ভূমিহীন, গরীব কৃষক, রাজনীতিসচেতন, মধ্য কৃষক, জঙ্গী বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত পরিবার হতে আগত কমরেডদের নিয়ে গেরিলা স্কোয়াড গঠন করা ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুর পরিধি বৃদ্ধি করা।’ 

৩। ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী সরকারের আশ্রয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ট্রেনিংরত তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আওয়ামী লীগ তার রাজনীতি ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালানো। কিন্তু মিলিটারী, শান্তি বাহিনী ও রাজাকারদের প্রবল আক্রমণের মুখে জনগণের মেজাজের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ক্ষুদ্র শক্তি কর্তৃক এই মুহূর্তে আওয়ামী বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা না করা।’ 

৪। ‘আওয়ামী লীগের কর্মীদের দেশপ্রেমিক অংশকে কৃষকের সশস্ত্র শ্রেণী যুদ্ধের মাধ্যমে পার্টির পতাকাতলে টেনে আনা।’ 

৫। ‘অবস্থা মোকাবেলার জন্যে একটি আধা প্রকাশ্যে কাজের ধারা বের করা।’ 

৬। ‘রাজনীতিহীন এ্যাকশনের প্রবণতাকে রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত করা’ প্রভৃতি। ১৪ জুনের বৈঠকের আগে ও পরে মধ্য আগস্ট পর্যন্ত জেলার কোথাও মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করেনি। ফলে ইপিসিপি (এম এল) তার মুক্ত অঞ্চলে পার্টি সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার সুযোগ পায়। আওয়ামী লীগ সমর্থনকারী অংশও পার্টির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কার্যকরী নয় শুধুমাত্র সামরিক ব্যবস্থা সমর্থনে এগিয়ে আসতে থাকে। এতে পার্টির সমর্থক বৃদ্ধি পেলেও তা ছিল পার্টির জন্যে একটি সমস্যা। কারণ তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার দরুণ পার্টি কর্মসূচী বাস্তবায়নে তারা কোন কাজেই আসছিল না। জুন মাসের শেষ দিকে 

মূলতঃ ইপিসিপি (এম এল)-এর হাতে দুটি থানা সদর দফতর ছাড়াও আরও ৬টি থানার শতকরা ৭০ ভাগ এলাকার কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। পুলুমের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ১৫ মাইল দূরে ছিলো মোহাম্মদপুর থানা। এ থানায় রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর শতাধিক সশস্ত্র সদস্য ছাড়াও ছিল জন পঞ্চাশেক বাঙালী পুলিশ। ইপিসিপি (এম এল)-এর লোহাগড়া আঞ্চলিক বাহিনী এখানে আক্রমণ পরিচালনা করে। রউফ ও মমতাজ ছাড়াও মোহাম্মদপুরের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় যোদ্ধার অসীম সাহসের ফলে থানাটি দখলে আসে। পার্টির আঞ্চলিক কমিটির সদস্য ও কর্মী আলী কদর, কুদ্দুস ও রায়হান যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। থানা আক্রমণের শুরুতেই পুলিশের লোকজন অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধরত কয়েকজন রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর লোক আত্মসমর্পণ করে। এতে তিনজন রাজাকার নিহত হয়। ইপিসিপি (এম এল) বাহিনীর একজন সামান্য আঘাত পান। থানা দখলের খবর সে সময় ফলাও করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়ে থাকে। তবে এই যুদ্ধ ও থানা দখল যে ইপিসিপি (এম এল) বাহিনী করেছে তা বেতার থেকে প্রচার করা হয়নি। অভয়নগর থানার বনগ্রাম, কালীনগর, হরিশনগর, বর্নী প্রভৃতি এলাকাতে গঠিত পার্টির গেরিলা বাহিনী এ সময় নিয়মিত টহলদার রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে মিলিত হতো। এখানে কুদলা ও মথুরাপুরে রাজাকার ও পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাদের যুদ্ধ স্মরণীয় হয়ে আছে। এ সমস্ত যুদ্ধের ফলাফল আরও দ্রুত গেরিলা স্কোয়াড গুলি সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে সাহায্য করে। জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইপিসিপি (এম এল) জেলা নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় নারিকেলবাড়িয়া ও লোহাগড়া অঞ্চল বিপ্লবী কমিটি গঠিত হয়। এরপর কোন কোন স্থানে বিপ্লবী কমিটি গঠিত হয় পরিত্যক্ত ও জোতদারদের জমির ধান দখল করার কমিটি হিসাবে। জেলা নেতৃত্ব পরিচালিত লাহুড়িয়াতে বিপ্লবী কমিটি ভূমিহীন ও গরীব কৃষকের নেতৃত্বে প্রতিনিধিমূলকভাবে গঠন করা হয়। বিপ্লবী কমিটির ক্ষমতা ও বিভিন্ন প্রশ্নে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় এ সময়। গেরিলা যুদ্ধের বিস্তৃতি এবং নিয়মিত ও স্থানীয় বাহিনী গঠনের কাজ সুসংগঠিতভাবে ত্বরান্বিত করার জন্যে জেলা কমিটি থেকে একটি সামরিক কমিশন গঠন করা হয়। তিন সদস্যের সামরিক কমিশন গঠন করা হয়। তিন সদস্যের সামরিক কমিশনের আহ্বায়ক হন পার্টির জেলা কমিটির সদস্য নূর মোহাম্মদ। সদস্যগণ হলেন জেলা কমিটির সম্পাদক শামসুর রহমান ও সদস্য বিমল বিশ্বাস। যুদ্ধের বিস্তৃতির সম্ভাবনাকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনী দ্রব্যাদি সরবরাহের জন্যে একটি সরবরাহ কমিটি গঠিত হয়।  

যশোরে স্বাধীনতার যুদ্ধে ইপিসিপি (এম এল)-এর যশোর জেলার যে দু’জন নেতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন বিমল বিশ্বাস ও নূর মোহাম্মদ। বিমল বিশ্বাস তখন ছিলেন পার্টির সামরিক বাহিনীর প্রধান। বর্তমানে তিনি কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। নূর মোহাম্মদ ছিলেন রাজনৈতিক কমিশনার। অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ৬২-র ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যশোর জেলার কেন্দ্রীয় সদস্য নূর মোহাম্মদ যুদ্ধের আগে বন্দবিলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ৭২-এর পর রাজনীতি থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন।  এ সময় ঘটনাবলী এত দ্রুত বিকশিত হচ্ছিল যে পার্টি সমস্ত কাজ শৃঙ্খলা ও সুসংগঠিতভাবে করতে পারছিল না। কোন কোন অঞ্চলে পার্টির সাংগঠনিক ভিত্তি নেই; কিন্তু সেখানেও বিপ্লবী কমিটি গঠিত হচ্ছিল। এইসব কমিটি অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও দায়িত্ব পার্টির উপরে এসে বর্তায়। এসব কমিটির কোন কোনটিতে মধ্য কৃষকের প্রাধান্য থাকায় তারা ভূমিহীন ও গরীব কৃষকের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়. এমন ধরনের কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে বসে। পার্টির নেতৃত্ব বুদ্ধিজীবী ও ধনী কৃষক পরিবার থেকে আগত ‘কমরেড’দের হাতে থাকায় কোন কোন স্থানে বিপ্লবী কমিটি হয়ে পড়ে শ্রেণী সহযোগিতার হাতিয়ার। এ সময়ের ঘটনাবলী মূল্যায়নে পর্যালোচনা রিপোর্টে বলা হয়েছে—‘বিপ্লবী কমিটির এইসব ক্রুটি সত্ত্বেও জেলার কয়েকটি অঞ্চলের গরীব কৃষকের। নিজেদের ক্ষমতার ব্যবহার করেন এবং ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেন। তারা জোতদার, মহাজন ও অত্যাচারী ধনী কৃষকদের অত্যাচারের কঠোর প্রতিশোধ নিতে ন্যূনতম দ্বিধাবোধ করেন না। বুদ্ধিজীবী কমরেডদের শ্রেণী সহযোগিতার রাজনীতি ও শ্রেণী সহযোগিতার অন্যান্য চক্রান্তকে চমৎকারভাবে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিতে থাকেন। 

তারা যে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে সক্ষম—এ তারা বিভিন্ন কাজের মধ্যদিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে প্রমাণ করতে থাকেন।’ এ সময় বিপ্লবী কমিটি প্রচলিত শাসন ও সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘোষণা করেন। পাকবাহিনীর দোসরদের কাছ থেকে দখল করা সম্পদ বন্টন করে দেয় ভূমিহীন ও গরীবদের মধ্যে। দখলীকৃত জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করারও ব্যবস্থা নেয়া হয়। পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও নতুন পদক্ষেপ নেয়ার জন্যে কমিটির পূর্ণাঙ্গ বৈঠক আহ্বান করা হয়। বৈঠকের কয়েকদিন আগে জেলা কমিটির হাতে ইপিসিপি (এম এল)-এর দুটি দলিল এসে পৌঁছায়। দলিল দুটিতে পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ আছে। এক নম্বর দলিলের মূল বক্তব্য : ‘পাক সরকার পূর্ব বাংলার জনতার ওপর আক্রমণ করেছে। সুতরাং এ যুদ্ধ—মুক্তিযুদ্ধ।’ দুই নম্বর দলিলের মূল বক্তব্য : ‘পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফলশ্রুতি হিসাবে ২৫ মার্চ পাক সরকার তার প্রতিদ্বন্দ্বী বাঙালী মুৎসুদ্দীদের ওপর আক্রমণ করেছে। এবং এ আক্রমণে জয়ী হবার জন্যে স্বভাবতই তাকে জনতার ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে হয়েছে।’ এখানে উল্লেখ প্রয়োজন যে ২৫ মার্চের পর করণীয় কি?—এ সম্পর্কে ইপিসিপি (এম এল)-এর কেন্দ্রী কমিটি যশোর জেলা কমিটির সঙ্গে কোন যোগাযোগ করেনি। সে কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল্যায়ন সম্পর্কে পার্টি সদস্যদের চিন্তা চেতনায় ভিন্নতা ছিল। 

জেলার বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে পার্টি সদস্যগণ তাই গেরিলা স্কোয়াড তৈরি ও যুদ্ধ শুরু করলেও অনেকে মনে করতেন পার্টি সমর্থকদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের জন্যে ভারতে পাঠানো উচিত। আবার অনেকে ভারতে যেতে ইচ্ছুক পার্টি সদস্যকে কঠোরভাবে সমালোচনা করতেন। এদিকে জেলা কমিটির জুন বৈঠকের আগে গোবরা ও খাজুরা এলাকার পতন ঘটে পাকবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে। দু’টি স্থানেই পার্টির ভিত্তি বেশ মজবুত ছিল বিশেষ করে গোবরা এলাকায়। গোবরাতে পার্টির জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য বিমল বিশ্বাসের নেতৃত্বে পার্টির শক্তিশালী একটি গেরিলা বাহিনী তৈরি হয়। কিন্তু পাকবাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে স্বল্প অস্ত্র নিয়ে পার্টি বাহিনীর ঘাঁটি করে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া পাকবাহিনীর হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের দরুণ গ্রামগুলি জনশূন্য হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে বিমল বিশ্বাসের নেতৃত্বে পার্টি বাহিনী সদর দফতর পুলুমে চলে আসে। খাজুরার গেরিলা স্কোয়াডও পুলুমে আসতে বাধ্য হয়। এ সময় পাকবাহিনীর হাতে একজন নেতৃস্থানীয় পার্টি সদস্য শালিখার রুস্তম মাস্টার শহীদ হন। ২০ আগস্ট জেলা কমিটির বৈঠকের পূর্ব থেকেই জেলার কিছু কিছু এলাকায় ভারত থেকে মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট ইউনিট প্রবেশ শুরু করে। ইপিসিপি (এম এল) বাহিনী তাদেরকে পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়াও খাদ্য দেয় ও নিরাপদ পথে গন্তব্যে পৌঁছাতে সহায়তা করে। ২০ আস্ট জেলা কমিটির পূর্ণাঙ্গ বৈঠক বসে। 

এই বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্দুল হক (বর্তমানে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা) উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আঞ্চলিক কৃষক রাজ ও নিয়মিত বাহিনী গঠনের আওয়াজ রাখা হয়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয় বিপ্লবী কমিটির গ্রামগুলিতে একত্রিত করার উল্লিখিত সিদ্ধান্তের আলোকে গৃহীত কর্মসূচীর মধ্যে ছিল— 

১। ‘অসংগঠিত বিপ্লবী কমিটিগুলিকে সুসংঘবদ্ধ করে আঞ্চলিক কৃষক রাজের পূর্বশর্ত সৃষ্টি করার জন্যে একই ধারায় বিপ্লবী কমিটি গঠন ও একই ধরনের আইন কানুন সর্বত্রই চালু করার জন্যে বিপ্লবী কমিটি গঠনের একটি সাংগঠনিক পদ্ধতি ও পুরাতন শাসন ও সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থা উচ্ছেদ প্রসঙ্গে একই ধরনের নির্দেশাবলী সম্বন্ধে একটি নীতিমালা বা ঘোষণা গৃহীত হয়।’ 

২। ‘বৈঠকে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অঞ্চলসমূহকে রক্ষা ও সম্প্রসারিত করার জন্যে অনতিবিলম্বে নিয়মিত বাহিনী ও স্থানীয় বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।’ 

৩। ‘জেলাকে আঞ্চলিক কৃষক রাজের এলাকা, বিপ্লবী কমিটি গঠনের এলাকা ও শত্রু এলাকা—রাজনৈতিকভাবে এই তিন এলাকায় বিভক্ত করা হয়।’ ২০ আগস্টের বৈঠকে পার্টির সামরিক কমিশনের অন্যতম সদস্য বিমল বিশ্বাসকে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। কমিশনের আহ্বায়ক নুর মোহাম্মদ রাজনৈতিক কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান। আগস্ট বৈঠকের পর বাঘারপাড়া থানার নারিকেলবাড়িয়া এলাকায় রাজাকার ও পাকবাহিনীর সঙ্গে পার্টি বাহিনীর নিয়মিত যুদ্ধ চলতে থাকে। শত্রুবাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী হলেও এর কোনটিতে তারা বিজয়ী হতে পারেনি। বরং অনেক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে তারা রণে ভঙ্গ দিয়েছে। এই এলাকাটি যশোর সেনানিবাস থেকে ২০ মাইলের মধ্যেই। ফলে, অতি অল্প সময়ে দ্রুত অধিক সংখ্যক পাকবাহিনীর সমাবেশ ঘটাতে পারায় এ অঞ্চলটিও হাতছাড়া হয়ে যায়। একই সময়ে অভয়নগরের বিস্তীর্ণ এলাকার যোদ্ধারা শত্রুবাহিনীর সামনে টিকতে না পেরে পেড়েলীর ঘাঁটি এলাকায় চলে যান। নারিকেলবাড়িয়া থেকে চলে আসা গেরিলা স্কোয়াড ও রেড গার্ডদের নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর প্রথম ইপিসিপি (এম এল)-এর লালবাহিনী গঠিত হয়। এ বাহিনীর কমান্ডার নিয়োগ করা হয় মুরাদকে। বাহিনীর ৯৯ ভাগই ছিলেন ভূমিহীন ও গরীব কৃষক। আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ইপিসিপি (এম এল) বাহিনীর কোন সামরিক সংঘর্ষ হয় না। কিন্তু তারা সংখ্যায় বেশি বেশি প্রবেশের পর পরই লালবাহিনীর উপর চড়াও হয়। পার্টির প্রতি দরদী মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন সদস্য খবর দেন—ভারত থেকে নির্দেশ এসেছে যে কোন মূল্যে লালবাহিনী ও তার নেতৃবৃন্দকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। ২৮ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন পার্টি সদস্য মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়। তারা রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না গিয়ে লালবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে থাকে। লালবাহিনীকে আক্রমণ, হত্যা, ও গ্রেফতার করার অভিযোগে এ সময় মুজিববাহিনীর একটি দলকে আটক রা হয়। পরে অবশ্য সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয় তিন-চতুর্থাংশ অস্ত্র ও গোলাবারুদ রেখে। পুলুম এলাকায় সমস্ত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পশ্চাদপসরণের সময় পর্যন্ত প্রতিদিনই পাকবাহিনীর আক্রমণ চলতে থাকে। কিন্তু লালবাহিনীর সাহসী যোদ্ধারা প্রতিবারই শত্রুকে হাটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। মুক্ত অঞ্চলকে ধ্বংস করার জন্যে এ সময় তারা শুরু করে চরম অর্থনৈতিক অবরোধ। 

সামরিক কমিশন এ মুহূর্তে সামরিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। 

১। অঞ্চল রক্ষার জন্যে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা। 

২। শত্রুর ঘাঁটিতে গেরিলা আক্রমণ চালানো। 

৩। শত্রুর এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ তীব্র করা। 

৪। শত্রুকে অঞ্চলে ঢুকতে দিয়ে ঘিরে ফেলা। 

৫। শত্রুর সামরিক ঘাঁটিগুলো চারিদিক দিক দিয়ে ঘিরে ফেলা। 

কয়েকটি অঞ্চলের পার্টি ও সেনাবাহিনী এক স্থানে কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে উদ্ভূত সামরিক অবস্থা মোকাবেলায় একটি আন্তঃআঞ্চলিক সামরিক কমান্ড গঠন করা হয়। জেলা সামরিক কমিশনের পরিচালনায় এই কমান্ড দৈনন্দিন সামরিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে যুদ্ধের প্রথমার্ধেই জেলা সামরিক কমিশন ও জেলা সরবরাহ কমিটির প্রত্যক্ষ পরিচালনায় জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক সামরিক কমিশন ও আঞ্চলিক সরবরাহ কমিটি গঠিত হয়। এ সময় সরবরাহ কমিটির কাজ দ্রুত বেড়ে যেতে থাকে। সেনাবাহিনীর খাদ্য, বস্ত্র ও ওষুধ সংগ্রহ হয়ে পড়ে জরুরী। শত্রু সম্পত্তি দখলের মাধ্যমে বিপ্লবী কমিটিই এগুলি পূরণ করতো। এই সময় লালবাহিনীর আহত সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য ঘোষগাঁতী গ্রামে একটি হাসপাতাল খোলা হয়। পার্টির সমস্ত শক্তি এ পর্যায়ে ও সরবরাহ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পার্টির দৈনন্দিন কাজ ও রাজনৈতিক প্রচার মূলতঃ বন্ধ হয়ে যায়। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি রাজাকার ও পাকবাহিনী পার্টি অঞ্চলকে ধ্বংসের জন্যে দূর্গনীতি অবলম্বন করে সমস্ত এলাকাটিকে ঘিরে ফেলতে থাকে। 

প্রবল শক্তি নিয়ে দখলদার বাহিনী নারিকেলবাড়িয়া, আড়পাড়া, শালিখা প্রভৃতি স্থানে ঘাঁটি তৈরি করে। এ সময় ইপিসিপি (এম এল)-এর সাংগঠনিক দৃঢ়তাও ঢিলেঢালা হয়ে যায়। গেরিলা যুদ্ধের জায়গায় কমান্ড এ্যাকশন ও নিয়মিত স্থানীয় যুদ্ধই যুদ্ধের একমাত্র পদ্ধতি হয়ে পড়ে। লালবাহিনী রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটি কেন্দ্রীয় বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। পার্টির কালীগঞ্জ গেরিলা অঞ্চল থেকে পুলুমে আগত বুদ্ধিজীবী পার্টি সদস্যদের প্রধান অংশ এ সময় নিজ এলাকায় ফেরত যাচ্ছিলেন। পথে আড়পাড়ার কাছে তারা রাজাকার বাহিনীর হাতে আটক হয়। সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা। শালিখাতে দখলদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি এ সময় পর পর দু’বার আক্রমণ করা হয়। প্রথম আক্রমণের শত্রুপক্ষে কয়েকজন নিহত হয়। শেষবারে লালবাহিনীর প্রথম কমান্ডার মুরাদ, শালিখা, বাঘারপাড়া এলাকার অন্যতম সংগঠক পার্টি সদস্য বিশ্বনাথ, লালবাহিনীর একজন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা নড়াইলের মাইঝপাড়ার সুকুমার, বুদ্ধিজীবী পার্টি কর্মী শালিখার হরিশপুরের আবুল বাশার এবং প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা সাইফ-উদ-দাহারের ভ্রাতুষ্পুত্র নড়াইলের এমরান শহীদ হন। 

একই সময়ে আর একটি বিপর্যয় ঘটে পার্টির বিচ্ছিন্ন মুক্ত অঞ্চল কেশবপুর ও মনিরামপুর এলাকা পতনের মধ্যদিয়ে। এ এলাকায় পার্টির অন্যতম নেতৃস্থানীয় সদস্য ও যশোর এম এম কলেজের প্রাক্তন ভিপি আব্দুল মতিন মুনীর গেরিলা বাহিনী তৈরিতে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এম এম কলেজের আর একজন প্রাক্তন ভিপি ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদ। সেনাবাহিনী হতে পার্টির ডাকে পদত্যাগকারী ফজলুর রহমান নামে একজন যুবক ছিলেন এ এলাকায় পার্টির অন্যতম যোদ্ধা। মনিরামপুর ও ঝিকরগাছা অঞ্চলে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও এম এম কলেজের প্রাক্তন ভিপি নজরুল ইসলাম, হেম এবং মোস্তফাও সশস্ত্র স্কোয়াড গঠন করেন। উভয় এলাকার সশস্ত্র স্কোয়াড কপোলিয়া, ডুমুরখালী, বাকড়া, গদখালী প্রভৃতি স্থানে রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়। তাদের আক্রমণে ডুমুরখালীতে জুলাই মাসের শেষ সপ্তায় ১৬ জন রাজাকার মারা পড়ে। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে পাক ও রাজাকার বাহিনীর আক্রমণে পার্টি বাহিনী মনিরামপুর ও কেশবপুর এলাকা ছেড়ে ইপিসিপি (এম এল)-এর যুদ্ধরত খুলনা এলাকার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। 

ডুমুরিয়া (খুলনা) থেকে যশোর অঞ্চলে ফেরার পথে ২৩ অক্টোবর আসাদ, ছাত্র ইউনিয়ন যশোর শাখা সভাপতি মানিক ও পার্টির সশস্ত্র বাহিনী কমান্ডার ফজলু চিনেটোলায় রাজাকার বাহিনীর হাতে আটক ও শহীদ হন। এর কয়েকদিন আগে হাজারীবাগ এলাকায় নজরুল, হেম ও মোস্তফা আটক হন রাজাকার বাহিনীর হাতে। পরে তাদের সন্ধান মেলেনি। এভাবে মনিরামপুর, কেশবপুর ও ঝিকরগাছা এলাকায় পার্টির সশস্ত্র স্কোয়াড গঠনকারী নেতৃত্ব শহীদ হন। নড়াইল লোহাগড়া এলাকার পার্টি কর্মীদের ভূমিকা ইপিসিপি (এম এল)-এর নড়াইল আঞ্চলিক কমিটি মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। নড়াইলের প্রথম পার্টি কর্মীদের হাতে অস্ত্র আসে। এ অস্ত্রের সাহায্যে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়। 

‘যশোর মার্চ ’-এ পার্টি নেতৃত্ব পালন করেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। নড়াইল ও লোহাগড়া আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক ছিলেন এককালের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লোহাগড়ার সরসুনা গ্রামের শেখ আব্দুস সবুর। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন মমতাজউদ্দীন, তবিরর রহমান মনু, এ্যাডভোকেট সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন প্রমুখ। ২৭ মার্চ সকালে কয়েক হাজার লোক নড়াইল ট্রেজারীর তিনশ’ আগ্নেয়াস্ত্র ও লক্ষাধিক রাউন্ড গুলি লুট করে। অস্ত্র লুটের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন যুক্ত থাকলেও ইপিসিপি (এম এল)-এর কর্মী সমর্থকরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ এবং নড়াইলের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক জনাব কামাল সিদ্দিকী অস্ত্র লুটে জনগণকে সহায়তা দেন। 

ইপিসিপি (এম এল)-এর পক্ষে সাইফ হাফিজুর রহমান ৫০টি রাইফেল ও ১০ হাজার রাউন্ড গুলি নিজ সংগ্রহে রাখেন। অসহযোগ চলাকালে পার্টি সদস্যদের হাতে আসা এগুলিই প্রথম অস্ত্র। ২৮ মার্চ পার্টি ব্যানার ও লাল পতাকা উড়িয়ে একটি বিশাল জঙ্গী মিছিল লোহাগড়ার সরসুনা এলাকা থেকে নড়াইল এসে পৌঁছে। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ আব্দুস সবুর। ২৯ মার্চ অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ, শেখ আব্দুস সবুর, সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য লেফটেন্যান্ট মতিয়ার রহমান এক বৈঠকে ‘যশোর মার্চ’-এর সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন মহকুমা প্রশাসকের বাসায় এক বৈঠকে ৫ এপ্রিল ‘যশোর মার্চ’-এর তারিখ নির্ধারিত হয়। এতে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া কালিয়া থেকে নির্ধারিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব এখলাসউদ্দীন উপস্থিত ছিলেন। এদিকে সংগৃহীত অস্ত্র নিয়ে পার্টি সদস্যরা একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন ও তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শহরের পাশে বরসুলাতে সামরিক প্রশিক্ষণ চলে। এটাই পার্টির প্রথম সামরিক বাহিনী ও সামরিক প্রশিক্ষণ। বাহিনীর প্রধান হন পার্টি সদস্য প্রাক্তন সৈনিক আব্দুর রউফ এবং রাজনৈতিক কমিশনার নিযুক্ত হন শেখ আব্দুস সবুর। 

৫ এপ্রিল নড়াইল থেকে ২২ মাইল পশ্চিমে যশোর অভিমুখে শুরু হয় ‘যশোর মার্চ’। ঢাল, সড়কী, রামদা ও অন্যান্য দেশী অস্ত্র ছাড়াও ‘মার্চকারীদের কাছে ৫শ’র মত আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। এর মধ্যে ইপিসিপি (এম এল)-এর সহস্রাধিক সমর্থক ছাড়াও আগ্নেয়াস্ত্রধারী কর্মীর সংখ্যা ছিল একশ’-এর উপরে। ৮ এপ্রিল মিছিলটি যশোর শহরের পূর্বপ্রান্তে ঝুমঝুমপুর ইপিআর ক্যাম্পের সন্নিকটে আসে। এখানে কয়েকশ’ বাঙালী-অবাঙালী ইপিআর ছাড়াও ছিল কিছু পাকবাহিনীর সদস্য। এ সময় ৫০ জন বাঙালী ইপিআর মিছিলকারীদের সঙ্গে অস্ত্রসহ যোগ দেন। সামান্য গুলি বিনিময়ের পর পাকবাহিনী সেনানিবাসে চলে যায়। ক্যাম্পের পাশেই এক বিহার পল্লী থেকে গুলি ছোঁড়া হলে জনতা তা ঘেরাও করে। এতে দাঙ্গাকারী ও চিহ্নিত কিছু লুটেরা (অবাঙালী) নিহত হয়। ইপিসিপি (এম এল)-এর কর্মীরা যশোর কারাগার ভেঙে রাজবন্দীদের মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। পার্টি নেতৃত্বে বের হয় মিছিল। পুরোভাগে ছিলেন শেখ আব্দুস সবুর, আব্দুর রউফ, হাফিজুর রহমান খোকন প্রমুখ। 

পার্টির সশস্ত্র কর্মীরাও এ মিছিলে ছিলেন। শহর প্রদক্ষিণ শেষে মিছিলটি যখন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে আসে তখন অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ৫ হাজারের উর্ধ্বে। জেলা কর্তৃপক্ষ প্রথমে বাঁধা দিতে চাইলেও জেল পুলিশেরা মিছিলকারীদের স্বাগত জানান। ফলে সহজেই জেলের তালা ভেঙে তিনশ’ জন আটক ও সাজাপ্রাপ্ত রাজবন্দীসহ সমস্ত হাজতী ও কয়েদীদের মুক্ত করে দেয়া হয়। মুক্ত হওয়া রাজবন্দীদের মধ্যে ছিলেন বর্তমান ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ও তৎকালীন ইপিসিপি (এম এল)-এর জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য অমল সেন, পার্টি সদস্য এ্যাডভোকেট সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, পার্টি সদস্য ইদ্রিস আলী, বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, ভূষণ কুমার রায়, গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস, পার্টি সমর্থক মনোয়ার হোসেন, খুলনার শ্রমিক নেতা আশরাফ হোসেন, নড়াইলের তেভাগা আন্দোলনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামী প্রখ্যাত বামপন্থী বাবু রসিক লাল ঘোষ প্রমুখ। কারামুক্ত নেতাদের নিয়ে পার্টি শ্লোগান সহ যশোর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করা হয়। 

১১ এপ্রিল সশস্ত্র পার্টি কর্মীসহ নেতৃবৃন্দ নড়াইল ফিরে আসেন। এ সময় নড়াইলের পার্টি সদস্যরা ইপিসিপি (এম এল)-এর জেলা কমিটির কাছ থেকে একটি পত্র পান। পত্রে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী’ জোয়ার ভেসে যাবার জন্যে পার্টির সদস্য ও কর্মীদের সমালোচনা করা হয়। তবে সে সময়ের আশু করণীয় কি? তার কোন নির্দেশ জেলা কমিটি দেননি। এ প্রেক্ষাপটে কর্তব্য নির্ধারণের জন্যে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ জেলা কমিটির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু তাৎক্ষণিক যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে তারা অস্ত্র সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেন। পার্টির হাতে এ সময় বিভিন্ন সূত্রে প্রায় পৌনে ৩শ’ অস্ত্র আসে। নড়াইল ও লোহাগড়ার বিভিন্ন এলাকার পার্টি সেল সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাদের অনেকেই সমর্থকসহ নড়াইলে চলে আসেন। ইতিমধ্যে পাকবাহিনী, ইপিআর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ হটিয়ে যশোর শহর দখল করে নিয়েছে। নড়াইল অভিমুখে তাদের অভিযান ঠেকাতে এ সময় দাইতলা ব্রীজের কাছে প্রতিরোধ লাইন তৈরি হয়। অন্যান্যদের সঙ্গে প্রতিরোধে অংশ নেন পার্টির সশস্ত্র সমর্থকগণ। 

১৮ এপ্রিল ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর হাতে নড়াইলের পতন ঘটে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব ভারতে পাড়ি জমান। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বহু যুবক ও ছাত্রও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। ইসিপিসি (এম এল)-এর নেতৃত্ব ও যোদ্ধা বাহিনী ৮ মাইল পিছিয়ে লোহাগড়ায় অবস্থান নেন। এখানে পার্টি নেতৃত্ব পাকবাহিনীর প্রতিরোধের বদলে গেরিলা কায়দায় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পার্টি সদস্যদের নেতৃত্বে কর্মীদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ করে তাদের স্ব স্ব এলাকায় চলে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। 

২৫ এপ্রিল লোহাগড়া থানা থেকে ১৭টি রাইফেল ও ১০ হাজার রাউন্ড গুলি নিয়ে শেখ আব্দুস সবুর ও অধ্যাপক নূর মোহাম্মদসহ অন্যান্যরা পার্টি প্রভাবিত লাহুড়িয়া এলাকায় চলে যান। নড়াইল ও লোহাগড়া দখলের পর পাকবাহিনী বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটি গঠন শুরু করে। এদের হাতে অস্ত্র দেয়া হয়। তারা বিভিন্ন এলাকায় লুটপাট চালাতে থাকে। এ সময় লোহাগড়ার রায় গ্রামের জ্ঞানেন্দ্র সরকারের বাড়িতে পার্টি সদস্য ও কর্মীদের এক বৈঠকে শান্তি কমিটির অত্যাচার ও লুটপাট প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২ মে পাকবাহিনী মধুমতি নদীপথে গানবোট ও লঞ্চ নিয়ে লোহাগড়ার ইটনা গ্রাম ঘেরাও করে। এখানে সবেমাত্র পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠছিল। সামান্য ক’টি অস্ত্র নিয়ে পার্টি সমর্থকরা শত্রুর প্রতিরোধ করে ব্যর্থ হয়। গ্রামের সমস্ত যুবক, ছাত্র ও স্বাস্থ্যবান লোকজনকে পাকবাহিনী গুলি ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পার্টির শীর্ষস্থানীয় কর্মী কমরেড হাফিজুর রহমান হিরুসহ মোট শহীদ হন তিনশ’ (৩০০) জন। এদের সিংহভাগই ছিলেন পার্টি সমর্থক। শান্তি কমিটির লুটপাটের পাশাপাশি চলতে থাকে অগ্নিসংযোগ। তারা বেছে বেছে পার্টি প্রভাবিত এলাকায় হামলা জোরদার করে। তাদের কৌশল ছিল এ অত্যাচারের ফলে লোকজন ঘর-বাড়ি ফেলে পালিয়ে যাবে পার্টির বাহিনী গ্রামবাসীদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবে। 

১১ এপ্রিল শতাধিক সশস্ত্র শান্তি কমিটি সদস্য পার্টি প্রভাবিত মুলিয়া ও কলোড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম আক্রমণ করে। এ এলাকার অধিকাংশ অধিবাসী ছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। লুটেরাদের আক্রমণে এখানে ৫ জন সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালাতে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যে ব্যাপক এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। পার্টির সহায়তাকারী অনেকগুলি এলাকা ভেঙে যায়। শান্তি কমিটির লোজনের শায়েস্তা করার জন্যে পার্টি নেতৃত্বে প্রথম অভিযান পরিচালিত হয় ১৫ মে লোহাগড়ার এক লুটেরার বাড়িতে। তিনি এই এলাকায় শান্তি কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন। এই অভিযানে শান্তি কমিটির ৪ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। 

১৭ মে নলদী বাজারে হামলা চালানো হয় শান্তি বাহিনীর একটি আখড়ায়। পূর্বাহ্নে খবর পেয়ে পালাতে সক্ষম হয় কয়েকজন। বাকী কয়েকজন আটক হয় এবং পরে ক্ষমা প্রার্থনা করায় ছেড়ে দেয়া হয়। এ সময় ইপিসিপি (এম এল)-এর আঞ্চলিক কমিটি লিফলেট ও পোস্টারের মাধ্যমে এক সপ্তাহের মধ্যে লুটের মালামাল ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়। লুটপাটকারীরা যে সমস্ত সংখ্যালঘুর বাড়ি থেকে মালামাল এনেছিল পুনরায় সে-সব তাদের বাড়িতে রেখে আসে। বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়া সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় মালামাল ফেরত পেয়ে বাড়ি ফিরতে থাকে। পার্টির সুনাম দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তবুও তখন কিছু কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্ন লুটপাট চলতে থাকে। পার্টি সফলভাবে তা বন্ধ করতে সক্ষম হয়। এ সময় লাহুড়িয়ার কুখ্যাত ছিরুসহ প্রায় ২৫ জন লুটেরাকে পার্টি নেতৃত্বে জনগণ বিভিন্ন স্থানে খতম করে। জনগণের জানমাল রক্ষার সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে পার্টি নেতৃত্বের উপর। পাশাপাশ চলতে থাকে পার্টির রাজনৈতিক প্রচার ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড। শেখ আব্দুস সবুর, এ্যাডভোকেট সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ, আবদুর রউফ, ইয়াসিন, তবিবর রহমান মনু, সাঈদ মাস্টার, শেখ হাফিজুর রহমান, আজিজুল হক, সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন, হেমায়েতউদ্দীন, হোসেন, লতিফুর রহমান সেলিম, মাস্টার আবদুস সাত্তার প্রমুখ সদস্য ও কর্মী গেরিলা স্কোয়াড গঠন ও অভিযানে নেতৃত্ব দিতেন। মে মাসের শেষে জেলা কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং তাদের সাথে আলোচনার জন্যে শেখ আব্দুস সবুর, মমতাজ ও আবদুর রউফ পুলুম যান। 

পুলুম থেকে জুন মাসে জেলা কমিটি তাদের অন্যতম সদস্য কমরেড রঘু ওরফে কমরেড রশীদ ওরফে বিমল বিশ্বাসকে লোহাগড়া অঞ্চলে পাঠান। তিনি লোহাগড়ার লাহুড়িয়াতে এসে পার্টির আঞ্চলিক কমিটি ও আঞ্চলিক বাহিনী গঠন করেন। রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে পার্টির মুক্ত এলাকার মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়। লাহুড়িয়া ছাড়াও সরসুনা, মহিষাপাড়া, কুমড়ি, বড়দিয়া ও ইটনায় পার্টি বাহিনীর ঘাঁটি মজবুত করা হয়। দ্বিমুখী লড়াই ও লোহাগড়া-নড়াইল এলাকার পতন জুলাই মাসের প্রথমার্ধে কমরেড রউফ, কমরেড মমতাজ ও এ্যাডভোকেট ওমর ফারুকের পার্টি বাহিনীর একটি অংশ লোহাগড়া থানা আক্রমণ করে। শতাধিক রাজাকার ও পুলিশকে লালবাহিনী ঘেরাও করে রাখে প্রায় ২৪ ঘন্টা যাবত। এ সময় ঘেরাও রাজাকার বাহিনীর সাহায্যে নড়াইল থেকে অতিরিক্ত রাজাকার ও পাকবাহিনী এসে উপস্থিত হয়। শেষ পর্যন্ত অবরোধ প্রত্যাহার করে পার্টি বাহিনী নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। এ যুদ্ধে লোহাগড়ার পাচুরিয়া গ্রামের কমরেড মিজান শহীদ হন। নিহত হয় শত্রুপক্ষের প্রায় ৪ জন রাজাকার। আহত হয়েছিল বেশ কয়েকজন। পুরো জুলাই ও আগস্ট মাসে টহলদার রাজাকার বাহিনীর সাথে লালবাহিনীর প্রতিদিনই বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। এ সময় রাজাকারদের সাথে রথোডাঙ্গা ও নাখোশীতে দু’টি বড় ধরনের লড়াই সংঘটিত হয়। 

নাখোশী ছিল নড়াইল শহরের এক মাইলের মধ্যে। কমরেড মমতাজের নেতৃত্বে পরিচালিত এ যুদ্ধে রাজাকার বাহিনী টিকতে না পেরে নড়াইলে পালিয়ে যায়। তাদের কয়েকজন হতাহত হয়। তবে এর বিস্তারিত খবর পাওয়া যায়নি। রাজাকার বাহিনী এরপর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পার্টি প্রভাবাধীন মুক্ত এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবারেই তারা ব্যর্থ হয়ে যায়। জুলাই মাসের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনী লোহাগড়া এলাকায় প্রবেশ করে। পার্টি বাহিনী তাদেরকে নিরাপদে বিভিন্ন এলাকায় যেতে সাহায্য করে। এসময় মৌখিকভাবে কথাবার্তা হয় যে কেউ কারো প্রভাবিত এলাকায় হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু আগস্ট মাসে ফরিদপুর জেলার একটি এলাকা থেকে লোহাগড়ার শালনগর মুক্তিবাহিনীর একটি ইউনিট হেমায়েতের নেতৃত্বে পার্টি এলাকায় চড়াও হয়। তারা এখান থেকে শাহবুল ও মাহবুবুল নামে দু’জন পার্টি সমর্থককে ধরে নিয়ে হত্যা করে। ফলে পার্টি বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষুব্ধ হন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসার প্রস্তাব যায় পার্টির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের কাছে। কিন্তু তারা আলোচনায় সাড়া দেয়নি। আগস্টের শেষ সপ্তাহে ইউনুসের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর আর একটি দল পার্টির মুক্ত এলাকায় আকস্মিক চড়াও হয়ে নড়াইল লোহাগড়া আঞ্চলিক কমিটির অন্যতম নেতা মমতাজের বাড়ি ঘেরাও করে। মমতাজ ও পার্টির অন্য একজন যোদ্ধা দুলাল সামরিক সংঘর্ষে না গিয়ে তাদের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তাতে মুক্তিযোদ্ধারা রাজী না হয়ে মমতাজ ও দুলালকে গুলি করে হত্যা করে। 

এভাবে রাজাকার বাহিনীর ত্রাস বলে পরিচিত সাহসী যোদ্ধা মমতাজ শহীদ হন। মমতাজের আততায়ীরা সে সময় স্থানীয় লোকজনকে জানায়-‘হাই কমান্ডের নির্দেশে পার্টির সবাইকে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে।’ এ ঘটনার পর পার্টির সাধারণ যোদ্ধারা নেতৃত্বের প্রতি চাপ দিতে থাকে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে। পার্টি নেতৃত্ব তা প্রত্যাখ্যাত করে পুনরায় আলোচনার জন্যে মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রস্তাব দেয়। তবে এসময় কিছু কিছু পার্টি সমর্থক কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ওপর বিচ্ছিন্ন হামলা চালায়। ১লা সেপ্টেম্বর নড়াইল ও গোপালগঞ্জ এলাকার প্রায় ৫শ’ মুক্তিযোদ্ধা আলফাডাঙ্গাতে সমবেত হয়। ৩রা সেপ্টেম্বর তারা পার্টির লাহুড়িয়া ক্যাম্প আক্রমণ করে। একই সময় পার্টি এলাকার ওপর পাক ও রাজাকার বাহিনীর টহলদারী আক্রমণ চলতে থাকে। পার্টি যোদ্ধারা কয়েক ঘন্টার যুদ্ধের পর আক্রমণকারী মুক্তিবাহিনীকে হটাতে সক্ষম হয়। পরে ২৪শে সেপ্টেম্বর আরও শক্তি নিয়ে মুক্তিবাহিনী লাহুড়িয়া এলাকায় হামলা চালায়। পাঁচ ঘন্টা অবিরাম যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে পার্টি বাহিনীর দু’জন সাহসী যোদ্ধা সরসুনার খসরু ও লাহুড়িয়ার আহমেদ শহীদ হন। তীব্র আক্রমণের মুখে পার্টি নেতৃত্ব কয়েকশ’ যোদ্ধাসহ পার্টির সরসুনা ঘাঁটিতে পশ্চাদপসরণ করেন। মুক্তিবাহিনীর কাছে পার্টি এলাকার পতন হলে তারা পার্টি দরদী ও বিশিষ্ট সমাজসেবী লাহুড়িয়ার বাদশাহ জমাদ্দার ও ওহাব জমাদ্দারকে মাকড়াইলে নিয়ে হত্যা করে। 

সদর দফতর পুলুম এর পতন ও ব্যর্থ ডুমুরিয়া মার্চ ১২ই অক্টোবর পার্টির সামরিক ও রাজনৈতিক সদর দফতর পুলুমের ওপর পাকবাহিনী-রাজাকারদের সহযোগিতায় প্রচন্ড আক্রমণ ‍শুরু করে। এ আক্রমণ ছিল উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে। আক্রমণ প্রতিহত করতে পূর্ব থেকেই পার্টি বাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটি ছিল উত্তরে আমুড়িয়া, দক্ষিণে বামনখালী এবং পশ্চিমে সরসুনায়। এই আক্রমণ এমন একসময় পরিচালিত হয় যখন বিভিন্ন স্থান থেকে চলে আসা সশস্ত্র স্কোয়াডগুলিকে পুনরায় সংগঠিত করা হচ্ছিল। যদিও পার্টি বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১২শ’র ঊর্ধ্বে এবং আরও ছিল তিন হাজার কর্মী। যাদের যুদ্ধে লাগানো যেতো। কিন্তু এর মধ্যে ৫শ’র বেশি যোদ্ধার গেরিলা যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। সবেমাত্র এ ব্যাপক সংখ্যক যোদ্ধাদের ‍পূর্ণাঙ্গ সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছিল। অন্যদিকে বুনাগাঁতী-শালিখা ও ধলগ্রাম এবং পাজারখালী থেকে আক্রমণকারী পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সংখ্যাও ছিল সহস্রাধিক। তাদের হাতে ছিল অত্যাধুনিক হালকা ও ভারী অস্ত্র। সমস্ত দিন তিন ফ্রন্টে যুদ্ধ চলে। পার্টি বাহিনীর অবস্থান চিল সুদৃঢ়। প্রচন্ড আক্রমণ সত্ত্বেও পার্টি বাহিনীর হতাহত ছিল নগণ্য সংখ্যক। পাকবাহিনীর পক্ষে বেশকিছু সৈনিকের নিহত হবার সংবাদ জানা গেলেও প্রকৃত তথ্য পার্টির পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। এ সময় খবর পাওয়া যায় পাকবাহিনীর পক্ষে আধা-সামরিক বাহিনী আরও কয়েকশ’ রেঞ্জার এসে যোগ দিয়েছে। বৃদ্ধি করা হয়েছে ভারী অস্ত্রের সংখ্যাও। ১৩ই অক্টোবরের প্রচন্ড আক্রমণে সদর দফতর পতন হবার আশংকা দেখা দেয়। পার্টির জেলা কমিটির সদস্য, নেতৃস্থানীয় সদস্য ও সামরিক কমান্ডারদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সদর দফতর ত্যাগ করার পক্ষে মত দেন অধিকাংশ সদস্য। সিদ্ধান্ত হয় সেনাবাহিনী ও সদস্যসহ অপর ঘাঁটি এলাকা পেড়েলী যাবার। প্রয়োজন হলে সেখান থেকে খুলনার ডুমুরিয়া এলাকায় পার্টি বাহিনীর ঘাঁটিতে পৌঁছানোর সিদ্ধান্তও রাখা হয়। তিনদিকে পাকবাহিনী ঘেরাও করে রাখায় তখন একমাত্র পূর্বদিকে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। 

আর এই পূর্বদিকে ছিল পার্টির ভেঙে যাওয়া লোহাগড়া অঞ্চল—যার দখল মুক্তিবাহিনীর হাতে। উল্লিখিত অঞ্চলে যাবার পথে সারাদিন দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। মিঠাপুকুর নামক স্থানে ভোরে পৌঁছানো হয় এবং দুপুর থেকে শুরু হয় আবারো দখলদার বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণ। এবারের আক্রমণ চালায় তারা বাঘডাঙ্গা থেকে। এতে কয়েকজন পার্টি সদস্য আহত হন। শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি জানা যায়নি। ১৫ই অক্টোবর পার্টি বাহিনী বারইপাড়া এসে পৌঁছায়। পরদিন ১৬ই অক্টোবর নবগঙ্গা নদীপথে সামনের দিক থেকে তিনটি লঞ্চ বোঝাই পাকবাহিনী ও রাজাকাররা এসে পথ রোধ করে দাঁড়ায়। সকাল থেকে বিকেল অবধি প্রচন্ড যুদ্ধ চলে। একই সময় পিছন দিক থেকে পার্টি বাহিনীর ওপর হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি ইউনিট। দ্বিমুখী আক্রমণের মধ্যে পার্টি বাহিনী বীরত্বের সাথে লড়ে চলে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ দুপুরের দিকে থেমে যায়। পার্টি বাহিনী আরও বেশি শক্তি নিয়োগ করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। বিকেলের দিকে অসংখ্য লাশ নিয়ে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা পিছু হটে যায়। পার্টি বাহিনীর দশজন যোদ্ধা শহীদ হন। পাকবাহিনীর হাতে আটক হয় ছ’জন। যুদ্ধে বাহিনীর দু’টি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভাগ হয়ে যাওয়া একটি অংশ লোহাগড়ার সরসুনা এলাকায় (পার্টির ভেঙে যাওয়া অঞ্চল) মুক্তিবাহিনীর দখলকৃত অঞ্চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। অপর দলটি পেড়েলী রওয়ানা হয়। সরসুনার দিকেদ যে সমস্ত নেতৃবৃন্দ যান তাদের মধ্যে ছিলেন পার্টির জেলা সম্পাদক শামসুর রহমান, জেলা কমিটির সদস্য হেমন্ত সরকার ও খবিরউদ্দীন আহমেদ এবং নড়াইল আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক শেখ আবদুস সবুর। পেড়েলীর দিকে যাওয়া নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন সামরিক কমিশনের আহ্বায়ক জেলা কমিটির সদস্য নূর মোহাম্মদ ও সামরিক বাহিনী প্রধান বিমল বিশ্বাস প্রমুখ। 

১৭ই অক্টোবর নৌকায় পৌঁছান নড়াইলের গোয়ালবাথান গ্রামে। সেখানে থেকে পায়ে হেঁটে এড়েন্দা হয়ে কামালপ্রতাপ গ্রামে। সেখান থেকে ডিঙ্গী নৌকায় ৭০ জনের এই বাহিনী পেড়েলী পৌঁছান ১৭ই অক্টোবর রাতে। মুক্তিবাহিনীর সাথে চুক্তি বারইপাড়া থেকে বিভক্ত হয়ে সরসুনায় আসা পার্টি বাহিনী ও নেতৃবৃন্দ মুজিব বাহিনীর নড়াইল অঞ্চলের কমান্ডার শরীফ খসরুজ্জামানের সাথে আলোচনা করে এর আগে আগস্ট মাসে পুলুম এলাকায় ভারত থেকে আসার সময় খসরুর ইউনিয়নের লোকজন পার্টি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিল। এ কারণে পার্টি বাহিনী তাকে আটক করে ও পরে ছেড়ে দেয়। আটককালীন খসরু অঙ্গীকার করেছিল যে ভবিষ্যতে উভয়পক্ষ কোন সংঘাতে না গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পাকবাহিনীর মোকাবিলা করবে। সে মোতাবেক ১৮ই অক্টোবর বাবরায় এক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পাটির পক্ষে শামসুর রহমান, খবিরউদ্দীন ও শেখ আবদুস সবুর অংশ নেন। খসরুজ্জামান ছাড়াও তাদের পক্ষে অংশ নেন মুক্তিবাহিনীর লোহাগড়া থানা রাজনৈতিক প্রধান মতিয়ার রহমান বাদশা। সিদ্ধান্ত হয়—পার্টি বাহিনী অস্ত্র জমা দেবে এবং পার্টি ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডে পার্টির বাহিনী পরিচালিত হবে। চুক্তি মোতাবেক পার্টি বাহিনী প্রায় তিনশ’ অস্ত্র জমা দেয়। কিন্তু পরে যৌথ কমান্ডে কোন বাহিনী গঠন করা হয়নি। বরং বিচ্ছিন্নভাবে তারা পার্টি সদস্য ও কর্মীদের হত্যা, বাড়িতে আগুন ও লুটতরাজ করতে থাকে। অচিরেই পার্টির অনেক শীর্ষস্থানীয় সদস্য ও যোদ্ধাকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। শেষ ঘাঁটি পেড়েলী যশোরে ইপিসিপি (এম এল)-এর সেনাবাহিনী ও বিপ্লবী কমিটির প্রকাশ্য অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পার্টির একমাত্র যে ঘাঁটির পতন ঘটেনি, সেটি হলো পেড়েলী। কালিয়া থানার পশ্চিমপ্রান্তে আতাই নদীর প্রান্ত ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ ঘাঁটি এলাকাটি ছিল সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা লাইন হিসেবে আতাই নদীর অবস্থান ঘাঁটিতে আরও নিরাপদ করে তোলে। 

অন্যদিকে পশ্চাতে হটে আসার জন্যে পশ্চিম ও উত্তরদিকে ছিল যোগাযোগহীন এক বিশাল জনপদ। কালিয়া থেকে ১০ মাইল পশ্চিম-দক্ষিণ, অভয়নগর থেকে ১৫ মাইল পূর্বে এবং নড়াইল থেকে ১৬ মাইল দক্ষিণে ছিল ঘাঁটির অবস্থানটি। মার্চের শেষের দিকে পার্টি সদস্যদের নেতৃত্বে সমর্থকগণ সশস্ত্রভাবে সংগঠিত হতে থাকেন। পেড়েলী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী চন্দ্রপুর, সাতবাড়িয়া ও জামরিলডাঙ্গা ছিল ঘাঁটি এলাকার অন্তর্ভূক্ত। বাহিনী সংগঠনের ব্যাপারে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন পার্টির জেলা কমিটির সদস্য খবিরউদ্দিীন আহমেদ ও সুধাংশ দে এবং পার্টি সভ্য গোলাম মোস্তফা (চন্দ্রপুর), মঞ্জু (পেড়েলী), কওসার শিকদার (পেড়েলী), জাকির হোসেন। গ্রুপ সদস্য আজিজ (পেড়েলী), টুকু (পেড়েলী), বাকিবিল্লাহ (পেড়েলী), পার্টি কর্মী গোলাম মোস্তফা (চন্দ্রপুর) প্রমুখ। প্রথমে ৮টি রাইফেল নিয়ে বাহিনী গঠিত হয় এবং শতাধিক পার্টি কর্মীকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এপ্রিলের প্রথম থেকেই দলে দলে লোকজন ভারতে যেতে থাকে। ফরিদপুর ও খুলনা থেকে আসা ভারতে যাবার একটি রুট ছিল ঘাঁটি এলাকার ওপর দিয়ে। পার্টি এসব শরণার্থীদের নিরাপদে ভারতে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়। ইতিমধ্যে শান্তি কমিটি গঠিত হয় এবং তারা বিভিন্ন এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের সম্পত্তি লুট ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। লুটপাটকারীদের সঙ্গে থাকতো দৌলতপুর ও খুলনা থেকে আগত সশস্ত্র অবাঙালীরা। ৮ই এপ্রিল পার্টি কমীরা অভয়নগরে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় লুটেরাদের বাঁধা দেয়। এতে তারা হটে গেলেও পার্টি সদস্য অভয়নগরের হানিফ গাজী ওরফে মন্টু শহীদ হন। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে নালামারায় লুটপাটকারী বিহারীদের সঙ্গে পার্টি বাহিনীর সারাদিন সশস্ত্র লড়াই হয়। পার্টির পক্ষে বাহিনীর নেতৃত্ব দেন গোলাম মোস্তফা ও কওসার। এতে কয়েকজন বিহারী মারা যায় বলে প্রকাশ। একই সময়ে সিদ্ধিপাশা, জয়রাবাদ, নলমারা, আমতলা, মাড়ুয়া লক্ষ্মীকাটি, রাধামাধবপুর, মাজিরগাঁতী প্রভৃতি এলাকায় লুট করতে আসা শান্তি বাহিনীর লোকজনকে পাটি বাহিনী হটিয়ে দেয়। ফুলতলা বাজারে ছিল শান্তি কমিটির প্রধান ছরোয়ার মোল্ল্যা ওরফে ছরো মোল্ল্যার বাড়ি। বিভিন্ন স্থানে শান্তি বাহিনীর লুটপাট অভিযান তার বাড়ি থেকে পরিচালিত হতো। লুটের মালামালও ভাগাভাগি হতো এখান থেকে। জনাদশেক সশস্ত্র শান্তিবাহিনী পাহারা দিয়ে রাখতো তার আস্তানা। 

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পার্টি সভ্য ‍ফুলতলায় শ্রমিক নেতা রফিকের নেতৃত্বে পার্টির ত্রিশজন সশস্ত্র যোদ্ধা ছরো মোল্ল্যার বাড়ি আকস্মিক আক্রমণ চালায়। যশোর-খুলনা মহাসড়কের অনতিদূরে ছরো মোল্ল্যার এ আস্তানায় হামলা পরিচালনা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। আক্রমণে ছরো মোল্ল্যার সস্ত্রীক নিহত হয়। শান্তি কমিটির অন্যান্য পালিয়ে যায়। পার্টির দখলে আসে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র। খবর পেয়ে পাকবাহিনী গানবোট নিয়ে গেরিলাদের পিছু ধাওয়া করে। কিন্তু ততক্ষণে সবাই নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যায়। একই সময় শান্তি কমিটির আরও কিছু লোক নিহত হয়। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্ব ভারতে পাড়ি জমায়। বিশাল এলাকায় পার্টির সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি কৃষকদের নিয়ে সংগ্রাম কমিটি ও গণমিলিশিয়া বাহিনী গঠনের কাজ চলতে থাকে। মিলিশিয়া বাহিনী প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রাক্তন সেনাবাহিনী সদস্য কওসার শিকদারকে। পার্টি মুক্ত এলাকায় নিজস্ব প্রশাসন চালু করে। সালিশ-বিচারের মাধ্যমে সমস্ত বিরোধ মিটানোর ব্যবস্থা করা হয়। ভূমিহীন কৃষকেরা দলে দলে পার্টির পতাকাতলে যোগ দেয়। ফেলে যাওয়া ব্যক্তিদের জমির ফসল কাটা ও তার সংরক্ষণ এবং একটি অংশ গরীব কৃষকদের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থাও নেয়া হয়। গরীব কৃষক পার্টি পতাকাতলে জমায়েত হওয়ায় বিত্তশালী চাষীদের অধিকাংশ পার্টির বিরুদ্ধে চলে যায়। এ সময় ঘাঁটি এলাকার ওপর পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর আক্রমণ তীব্রভাবে বেড়ে গেলে পার্টির রাজনৈতিক প্রচার মূলতঃ বন্ধ করতে হয়। দখলদার বাহিনীর মোকাবেলাতেই ব্যস্ত থাকতে হয় পার্টি শক্তিকে। ফলে, দলে দলে পার্টির বাহিনীতে যোগ দেয়া সমর্থকদের মধ্যে বাম হঠকারিতা বেড়ে যায়। আগস্ট মাসে কালিয়া, নড়াইল, অভয়নগর ও দৌলতপুর ক্যাম্প থেকে নদীপথে প্রায় প্রতিদিনই রাজাকার ও পাকবাহিনী ঘাঁটি এলাকার ওপর হামলা চালাতে থাকে। এ সময় বহুবার টহলদার পাকবাহিনীর ওপর গেরিলা হামলা চলে এবং তাতে তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে নড়াইল থেকে আগত লঞ্চ বোঝাই পাক ও রাজাকার বাহিনীর ওপর খরকিয়া গ্রামের কাছে সফল আঘাত হানা হয়। এতে শত্রুপক্ষের তিন জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয় বলে জানা যায়। পাকবাহিনী লঞ্চ থেকে তীরে নামতে না পেরে ফিরে যায় নড়াইলের দিকে। 

আগস্টের শেষ সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পার্টির মুক্ত অঞ্চল বিষ্ণুপুর গ্রামে এসে অবস্থান নেয়। তাদের সাথে পার্টি বাহিনীর এক সংঘর্ষে পার্টির একজন সাহসী যোদ্ধা দৌলতপুরের মন্টু শহীদ হন। আটক করা হয় মুক্তিবাহিনীর চারজন যোদ্ধাকে। পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। আপোস আলোচনার প্রস্তাব দেয় উভয়পক্ষ। পরে মুক্তিবাহিনী কোন আলোচনায় বসতে রাজী হয় না। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর পর্যন্ত পার্টি একাধিকবার পাক ও রাজাকার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে। এলাকা দখলের প্রতিযোগিতা নিয়ে ছোটখাটো বিরোধ চলতে থাকে মুক্তিবাহিনীর সাথেও। পার্টির সদর দফতরের পতন ঘটলে ১৭ই অক্টোবর জেলা কমিটির কয়েকজন নেতা, নিয়মিত বাহিনী প্রধান ও ৭০ জনের মত যোদ্ধা পেড়েলী এসে উপস্থিত হয়। সেনাবাহিনীর প্রকাশ্যে অস্তিত্ব থাকা পর্যন্ত পেড়েলীতে পার্টির ঘাঁটি ছিল। পার্টি, সেনাবাহিনী ও বিপ্লবী কমিটির প্রকাশ্য অস্তিত্ব বিলুপ্ত ঘোষণা ১৭ই অক্টোবর পুলুম থেকে সামরিক কমিশন প্রধান ও বাহিনীর প্রধান পেড়েলী এসে মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় ইউনিটের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তারা আলোচনায় না এসে ২১শে অক্টোবর রাতে আকস্মিকভাবে পার্টির ঘাঁটির ওপর আক্রমণ শুরু করে। 

প্রায় ৩শ’ মুক্তিযোদ্ধা ছিল ভারী অস্ত্র সজ্জিত। জামরিয়া ডাঙ্গা ও সাতবাড়িয়াতে চিত্রা নদীর উত্তর পাশে অবস্থান নেয় মুক্তিবাহিনী। দক্ষিণ পাশে ছিল পার্টি বাহিনীর অবস্থান। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। পার্টি বাহিনীর পক্ষে কয়েকজন হতাহত হয়। এদের মধ্যে পার্টির অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা লাহুড়িয়া কালীগঞ্জের আকবর আলীর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারাও ক্ষয়ক্ষতিসহ শেষ পর্যন্ত হটে যায়। ঐ রাতে পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্য ও যোদ্ধারা বৈঠকে বসেন। পেড়েলী থেকে বাহিনী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অবস্থান নেয়া হয় নোয়াপাড়া এলাকার (পূর্বে ভেঙে যাওয়া) পূর্ব-উত্তর প্রান্তে বনখলসীখালী বা বড়কুলায়। খুলনার ডুমুরিয়া যাবার পথ নিরাপদ না থাকায় পার্টি বাহিনী সে আশা পরিত্যাগ করে। ২৫শে অক্টোবর রাতে নূর মোহাম্মদ, বিমল বিশ্বাস, বদ্যিনাথ বিশ্বাস, নাজির হোসেন, জবেদ আলী প্রমুখ পার্টি সদস্যের উপস্থিতিতে এক বৈঠক বসে। এতে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে ‘বতমান সময় আত্মরক্ষার সময়’ বলে ঘোষণা করা হয়। পার্টি, সেনাবাহিনী ও কর্মীদের আত্মগোপনের নির্দেশ দিয়ে পার্টি, সেনাবাহিনী ও বিপ্লবী কমিটির প্রকাশ্য অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা হয়। এদিকে পেড়েলী থেকে পার্টি বাহিনী প্রত্যাহারের সময় সেখানকার লোকালবাহিনী প্রধান কওসার ও ৪০ জন যোদ্ধা অস্ত্রসহ থেকে যায়। তারা মূলতঃ এলাকা ত্যাগে রাজী হয় না। ২৪শে অক্টোবর কওসার ও তার বাহিনী অস্ত্রসহ কালিয়া থানার কলবাড়িয়া গ্রামে মুক্তিবাহিনী কমান্ডার কালামের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কালামের নির্দেশে এক সপ্তাহ’র মধ্যে কওসারসহ ৩০ জন যোদ্ধাকে গুলি ও অন্যান্যভাবে হত্যা করা হয়। শহীদ পার্টি সদস্য ও কর্মীর সংখ্যা তৎকালীন জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দের হিসাব অনুযায়ী স্বাধীনতাযুদ্ধে পাটির কমপক্ষে এক হাজার কর্মী শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে অর্ধেক পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে। আর বাকিটা মুজিববাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হাতে বলে পার্টি সূত্র জানায়। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে শহীদ নেতৃস্থানীয় সদস্য ও কর্মীদের মধ্যে রয়েছেন—নজরুল, তোজো, আসাদ, শান্তি মানিক, নিরাপদ, আলাল, হানিফ, ওহাব, মিজানুর, মুরাদ, ইমরান বাশার, বিশ্বনাথ, কুটিমিয়া, বিনয়, মন্মথ, রুস্তম মাস্টার, আবু বকর প্রমুখ। মুজিববাহিনী ও মুক্তিবাহিনী কর্তৃক—খবিরউদ্দীন, মমতাজ, রফিক, হবিবর, হোসেন, ইয়াসিন, রউফ, শাহাবুল, মাহাবুল, পাখি, আতিয়ার, আকবর, আজিজ, তারাপদ মাস্টার, হাতেম, মহিউদ্দীন, কুদ্দুস, পল্টু, রায়হান, মর্জিনা, সুফিয়া প্রমুখ। 

মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনী ১৯৭১-এর ডিসেম্বর, ১৯৭২-এর জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী, মার্চ, এপ্রিল, মে, জুন পর্যন্ত পার্টি প্রভাবিত এলাকায় হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ চালাতে থাকে। স্বাধীনতাযুদ্ধে ইপিসিপি (এম এল)-এর সাফল্য ও ভুল-ক্রটি স্বাধীনতা যুদ্ধে ইপিসিপি (এম এল)-এর যশোর শাখার ভূমিকা এবং এর সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে বস্তুগত আলোচনায় কেউ এগিয়ে আসেন নি। কেউ কেউ বলেন ব্যাপক জনগণের সাথে সংযোগহীন তাদের কার্যকলাপ ছিল সন্ত্রাসবাদীদের মত। তাই মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেয়া যায় না। আবার অনেকে বলে—দীর্ঘ আট মাস দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ এবং জনগণের জানমাল রক্ষাকারী হিসেবে তাদের ভূমিকা-স্বাধীনতার সৈনিকের মতই। মুক্তিযুদ্ধে এদেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও বেশ ক’টি বামপন্থী দলও গ্রুপ অংশগ্রহণ করে। তাদের সঙ্গে ইপিসিপি (এম এল)-এর যশোর কমিটির পার্থক্য এই যে, যশোর কমিটি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পাশাপাশি কৃষক রাজ কায়েমের জন্যে জোতদার ও বনী কৃষকদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরেছে। ভূমিহীন কৃষকদের নিয়ে দখল করে নিয়েছে জোতদারদের উদ্বৃত হাজার হাজার একর জমি। দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী ছাড়া তাই ইপিসিপি (এম এল)-এর যশোর শাখা যুদ্ধ করেছে বাঙালী জোতদারদের বিরুদ্ধেও। সে কারণে জোতদার পরিবারের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে পরে পার্টি বাহিনীর পতনকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছে। একাত্তরে পার্টির জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ ও নেতৃস্থানীয় সদস্যের (যাদের অনেকেই এখন বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ইউপিপি এবং বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি করেন) বহুজনের সাথে আমার কথা হয়েছে। তাদের একপক্ষ বলেন—‘আমরা পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের পাশাপাশি পার্টির কর্মসূচী প্রয়োগ করেছি এটাই একাত্তরে আমাদের সাফল্য।’ 

অন্যপক্ষ বলেন : জনগণ চাচ্ছিল দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কিন্তু আমরা পার্টি রাজনীতিকে মুখ্য হিসেবে প্রয়োগ এবং দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে গৌণ হিসেবে প্রয়োগ করেছি। এটাই আমাদের ব্যর্থতা। তবে উভয়পক্ষ স্বীকার করেন যে ১৯৭১ সম্পর্কে ইপিসিপি (এম এল)-এর মূল্যায়ন ও কৌশল সম্পূর্ণ সঠিক ছিল না। যশোর জেলা কমিটির পর্যালোচনামূলক রিপোর্টে একাত্তরের ২৫শে মার্চের পর পার্টির সাফল্য ক্রুটি ও বিচ্যুতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করা হয়েছে (জনযুদ্ধ, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, আগস্ট ১৯৭২)। এতে সাফল্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে— 

(১) জেলার কয়েকটা অঞ্চলে ভূমিহীন গরীব কৃষক ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করে। অসম্পূর্ণভাবে হলেও স্বাধীন বাংলার বিপরীত চিত্র হিসেবে জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার বাস্তব চিত্র কৃষক জনতার সামনে হাজির করা সম্ভব হয়। শান্তিপূর্ণভাবে ও প্রকাশ্য আন্দোলনের মারফত নয়—একমাত্র কৃষকের সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে, কৃষকের সেনাবাহিনী গড়ে ও পার্টি অঞ্চল গড়ার মধ্যদিয়েই বৃহত্তর কৃষক জনতার মুক্তি আসতে পারে। এ উপলব্ধি বাস্তব সংগ্রামের মধ্যদিয়েই বৃহত্তর কৃষক জনতার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। 

(২) সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামকে নানাভাবে ব্যাপক জনতাও অংশগ্রহণ করে। 

(৩) ভূমিহীন-গরীব কৃষকরা পার্টি ও সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকায় বেশি বেশি করে এগিয়ে আসে। 

(৪) পার্টির নেতৃত্বে ভূমিহীন গরীব কৃষকরা সামন্তবাদী শোষণ ও শাসন ব্যবহারের ওপর প্রচন্ড আঘাত হানেন। 

(৫) সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যদিয়ে পার্টি সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পর্কে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করে। 

(৬) বেশি সংখ্যায় ভূমিহীন গরীব কৃষক পার্টির নেতৃত্বে কঠোর যুদ্ধের মধ্যদিয়ে প্রকৃত লাল সৈনিক হিসেবে গড়ে ওঠে। 

(৭) শত্রুর প্রবল আক্রমণে পার্টি ও সেনাবাহিনী অবশ্যই ধ্বংস হয়নি। সাংগঠনিক ভিত্তি ও সেনাবাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়েছে ঠিকই। এবং এটাও ঠিক যে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

কিন্তু তবুও আমরা মোটেই ধ্বংসপ্রাপ্ত নই। আমরা শত্রুর আক্রমণের সামনে আত্মগোপন করেছি। আমাদের রাজনীতিকে আমরা যেভাবে বাস্তব সংগ্রামের মধ্যদিয়ে তুলে ধরতে পেরেছি সেটা আমাদের বিরাট সাফল্য। ক্রুটি ও ব্যর্থতা 

(ক) ‘মূলতঃ পার্টির নেতৃত্ব বুদ্ধিজীবী ও ধনী কৃষকের ঘর হতে আগত কমরেডদের হাতে থেকে যায়। 

(খ) পার্টি প্রকাশ্য হয়ে পড়ায় ও উপলব্ধির অভাবে পশ্চাদপসরণের সময় গেরিলা স্কোয়াডের একাংশ ও নেতৃস্থানীয় কর্মীদের একাংশ ঐসব স্থানে রেখে আসা সম্ভব হয়নি। 

(গ) যে রাজনৈতিক উপলব্ধির দ্বারা ক্ষমতা দখলের আওয়াজ রাখা হয়—সেই উপলব্ধির ভিত্তিতে জেলা পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করা যায় না বলে পদক্ষেপের ভিন্ন প্রকাশ হতে থাকে। 

(ঘ) স্বাধীন বাংলার রাজনীতিকে ব্যাপকভাবে আদর্শগত ক্ষেত্রে পরাস্ত করার দুর্বল পদক্ষেপে নেয়া হয়। যার ফলে জনতার একাংশের কাছে আমরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে তাদের দায়িত্বই কমিউনিস্ট পার্টি পালন করেছে বলে মনে হতে থাকে। য্খন মুক্তিবাহিনী বেশি বেশি করে প্রবেশ করতে থাকে তখন কোন কোন স্থানের জনতার একাংশ তাদের সাথে মিলিত হয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার দাবী করে।’

Taken from the pages of history - ইতিহাসের পাতা থেকে নেওয়া।

Taken from the pages of history -  ইতিহাসের পাতা থেকে নেওয়া। 




☞নোবেল চালু → ১৯০১ সালে।

☞ফিফা গঠিত → ১৯০৪ সালে।

☞বঙ্গভঙ্গ → ১৯০৫ সালে।

☞বঙ্গভঙ্গ রদ → ১৯১১ সালে।

☞টাইটানিক ধংস → ১৯১২ সালে।

☞রবীন্দ্রনাথের নোবেল লাভ → ১৯১৩ সালে।

☞১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় → ১৯১৪ সালে।

☞রুশ বিপ্লব → ১৯১৭ সালে।

☞১ম বিশ্বযুদ্ধ শেষ → ১৯১৯ সালে।

☞২য় ভার্সাই চুক্তি → ১৯১৯ সালে।

☞ম্যাগনাকার্টা → ১২১৫ সালে।

☞উত্তর আমেরিকা আবিস্কার → ১৪৯২ সালে।

☞শিল্প বিপ্লব → ১৭৬০ সালে।

☞আমেরিকা মুক্ত → ১৭৭৬ সালে।

☞১ম ভার্সাই চুক্তি → ১৭৮০ সালে।

☞ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ → ১৮০০ সালে।

☞ট্রাফালগার যুদ্ধ → ১৮০৫ সালে।

☞ওয়াটার লুর যুদ্ধ → ১৮১৫ সালে।

☞দাশ প্রথার বিলোপ → ১৮৬৩ সালে।

☞আব্রাহাম লিংকন মারা যান → ১৮৬৫ সালে।

☞সুয়েজ খাল খনন → ১৮৬৯ সালে।

☞ফরাসি বিপ্লব → ১৭৮৯ সালে।

☞দুই জার্মানী একত্রিত হয় → ১৯৯০ সালে।

☞শিমন পেরেজ+ইয়াসির আরাফাত নোবেল পান → ১৯৯৩ সালে।

☞নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হন → ১৯৯৪ সালে।

☞সিটি বিটি সই হয় → ১৯৯৬ সালে।

☞সিটি বিটি অনুমোদন → ২০০০ সালে।

☞জাতিসংঘ নোবেল পায় → ২০০৭ সালে।

☞দঃ সুদান স্বাধীন হয় → ২০১১ সালে।

☞এপিজে আঃ কালাম মারা যান → ২০১৫ সালে।

☞মোঃ আলী মারা যান → ২০১৬ সালে।

☞ফিডেল কাস্ত্রো মারা যায় → ২৫ নভেম্বর,২০১৬ সালে।

☞ঢাবি স্থাপিত → ১৯২১ সালে।

☞হিটলার জার্মান চ্যান্সলর হন → ১৯৩৩ সালে।

☞২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু → ১৯৩৯ সালে।

☞ছিয়াত্তরের মনবন্তর → ১১৭৬ (বাংলা) সনে। 

☞২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ → ১৯৪৫ সালে।

☞জাতিসংঘ → ১৯৪৫ সালে।

☞দেশ বিভাগ → ১৯৪৭ সালে।

☞আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ → ১৯৪৮ সালে।

☞বিবিসি বাংলার যাত্রা → ১৯৪৯ সালে।

☞এভারেস্ট বিজয় → ১৯৫৩ সালে।

☞সুয়েজ খাল জাতীয়করন → ১৯৫৬ সালে।

☞চাঁদে ১ম মানুষ যায় → ১৯৬৯ সালে।

☞তাইওয়ান স্বাধীনতা হারায় → ১৯৭১ সালে।

☞ইরানে ইসলামী বিপ্লব → ১৯৭৯ সালে।

☞আঃ ছালাম ও মাদার তেরেসার নোবেল লাভ → ১৯৭৯ সালে।

☞ফকল্যান্ড যুদ্ধ → ১৯৮২ সালে।

Confusion is gone - Which hero was martyred for the first time in 1971? - কনফিউশন দূর - কোন বীর শ্রেষ্ঠ প্রথমে শহীদ হন ? - bcs online exam

Confusion is gone - Which hero was martyred for the first time in 1971? - কনফিউশন দূর - কোন বীর শ্রেষ্ঠ প্রথমে শহীদ হন ?


bcs online exam


এই নিয়ে বিভিন্ন গাইড বইয়ে  অনেক জলঘোলা হয়েছে  - এবার কনফিউশন দূর করল প্রথমআলো পত্রিকা । 

বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল শহীদ হন -১৮ এপ্রিল ১৯৭১

বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ শহীদ হন -২০ এপ্রিল ১৯৭১








এক নজরে ৭ মার্চের ভাষণঃ

এক নজরে ৭ মার্চের ভাষণঃ
=>UNESCO বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে কবে 'বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য' হিসেবে ঘোষণা করে?
৩০ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার। IAC'র ১৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি বিভিন্ন দেশ থেকে পাঠানো ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল, নথি ও বক্তৃতাকে যাচাই-বাছাই করেন এবং UNESCO'র মহাপরিচালক এই ঘোষণা দেন।বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ নথি,দলিল, পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য UNESCO ১৯৯২ সালে Memory of the World Register কর্মসূচি চালু করে। প্রতি দুই বছর পর পর এই কর্মসূচি পালন হয়ে আসছে এবং ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৪২৭ টি দলিল ও সংগ্রহ Memory of the World Register-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং এই ৪২৭টি প্রামাণ্য ঐতিহ্যের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই একমাত্র ও প্রথম অলিখিত ভাষণ।
=> ৭ মার্চের ভাষণ কখন শুরু হয়েছিল ?
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ শুরু হয় বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে,ভাষণের চিত্র ধারণকারী ছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম কর্পোরেশনের পরিচালক আবুল খায়ের এমএনএ।
=>৭ মার্চের ভাষণ কত মিনিটের ছিল?
রেকর্ডকৃত ভাষণের মোট সময় ছিল ১৯ মিনিট। ভাষণ রেকর্ডকারীর নাম এ এইচ খন্দকার। ভাষণের মোট শব্দ সংখ্যা ১১০৮টি।
=>৭ মার্চের ভাষণ কতটি ভাষায় অনূদিত হয়?
১২টি ভাষায় অনূদিত হয়। ভাষণ চলাকালীন প্রায় দশ লক্ষ মানুষ উপস্থিত ছিল।
=>১৯৭১ সালের ৭ মার্চের দিনটি ছিল?
রবিবার
=>৭ মার্চের ভাষণ চলাকালীন পাকিস্থানে যে আন্দোলন চলছিল?
অসহযোগ আন্দোলন।
=>৭ মার্চের ভাষণের মূল বিষয় কয়টি ছিল?
৪ টি
=>বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঐতিহাসিক জ্যাকব এফ ফিল্ডের রচিত we shall Fight pn the Beach :The Speech the Inspired History গ্রন্থে কি নামে পরিচিতি পায়?
The Struggle : This Time is the Struggle for Independence.
=>বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ "বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য" স্বীকৃতি লাভের পেছনে কোন দুজন বাংলাদেশীর অবদান বেশী ?
ফ্রান্সের প্যারিসে বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত মোঃ শহিদুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।
=>"শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুধুমাত্র একটি ভাষণ নয়,এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল" উক্তিটি কার?
কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো।
=>"৭ মার্চের ভাষণ আসলে ছিল স্বাধীনতার মূল দলিল" উক্তিটি কার ?
বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।

দাজ্জালের মরন গেইট! দাজ্জালকে কোথায় কতল করা হবে জানেন?

দাজ্জালের মরন গেইট!!!
দাজ্জালকে কোথায় কতল করা হবে জানেন?ইহুদিদের দেশে সাদা স্বেত পাথরের বিশাল এক গেইট এর নীচে।
সেই গেইট ইতিমধ্যে ইহুদিরা নির্মাণ করে ফেলছে তেলআবিব থেকে প্রায় পনের কিলোমিটার দূরে।
গুগলে সার্চ দিলেই পাবেন।

কে কতল করবেন জানেন?
হযরত ইসা আঃ, তিনি আকাশ থেকে দুই ফেরেশতার কাধে ভর করে সিরিয়ার দামেস্ক শহরের বিশাল মসজিদের সাদা মিনারে এসে নামবেন।
খোঁজ নিয়ে জানলাম সেই বিশাল মসজিদ আজ থেকে ৭০০ বছর আগেই তৈরী হয়ে গেছে।
একি স্থানে একি বর্ণনা অনুযায়ী, একদম হযরত আবু হুরায়রা রঃ এর বর্ণনানুযায়ী।
তখন সমুদ্রের নীচে আগুন থাকবে আগুনের নীচে পানি থাকবে।
শুনতে আজিব লাগছে না তাই না?
প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন স্থানে পানির নীচ থেকে এখন ধাউ ধাউ করে আগুন বেরুচ্ছে।
তখন আরব দেশে বরফ জমতে থাকবে। গত দুই বছর ধরে সেটাই হচ্ছে।
তখন ইরাক সিরিয়ার মধ্যবর্তী ফুরাত নদী শুকিয়ে যাবে।
সেখানে বিশাল এক স্বর্নের পাহাড় ভেসে উঠবে, এটা নিয়ে সবাই যুদ্ধ করবে।
আজকে ফুরাত নদী প্রায় ৯৫ ভাগ শুকিয়ে গেছে, বিভিন্ন দেশের আর্মিরা সে জায়গাটা ঘিরে রেখেছে।
এর আগে ইমাম মাহদি ( অর্থাৎ সু পথ প্রাপ্ত নেতা) আত্ম প্রকাশ করবেন। যার নাম হবে মোহাম্মদ, পিতার নাম আব্দুলাহ।
তিনি হুবহুব হযরত মোহাম্মদ সঃ এর মতো সুন্দর ও সুঠাম দেহের অধিকারী হবেন। সুবহানাআল্লাহ।
ইমাম মাহদি যেদিন আত্ম প্রকাশ করবেন সেদিন হবে রোজ শক্রবার এবং মক্কার ১৫ রমজানের দিন।
আশ্চর্যের বিষয় হলো গত ২০১০ সাল থেকে মক্কার প্রতিটা ১৫ই রমজান ছিলো শুক্রবার এবং ক্যালেন্ডার দেখলে জানতে পারবেন আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত মক্কার প্রতিটি ১৫ রমজান হবে শুক্রবার।
কি মনে হয় কেয়ামত খুব দূরে?
হাদিস কোরআন মিথ্যে?
কি মনে হয়?

♥ কাশ্মীরের ইতিহাস ♥ ♠ নামটি কেন কাশ্মীর...? - History of Kashmir - Why is the name Kashmir?


কাশ্মীরের ইতিহাস
নামটি কেন কাশ্মীর...?

লোককথা অনুযায়ী, ‘কাশ্মীর’ মানে হল ‘শুষ্ক ভূমি’। দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলহন-এর লেখা কাশ্মীরের ইতিহাস ‘রাজতরঙ্গিণী’ থেকে জানা যায় যে কাশ্মীর উপত্যকা পূর্বে একটি হ্রদ ছিল। হিন্দু পুরাণে বর্ণনা করা আছে সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মার পৌত্র মহাঋষি কশ্যপ বারামূলা(বরাহমূল) পাহাড়ের একাংশ কেটে হ্রদের জল নিষ্কাশন করেন।
কাশ্মীর সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার পর কশ্যপ ব্রাহ্মণদের সেখনে বসতি স্থাপন করা্র জন্য আমন্ত্রণ করেন। এই কাহিনী স্থানীয় ঐতিহ্যে আজও রয়ে গেছে, এবং এই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থাও অনেকটাই সমর্থন করে।
কশ্যপের সাথে হ্রদ নিষ্কাশণের যোগাযোগ ঐতিহ্যগত ইতিহাসেও পাওয়া যায়,যা বোঝা যায় উপত্যকায় বসবাসকারীদের প্রধান শহরের নাম ‘কশ্যপ-পুরা’ থেকে, যার উল্লেখ আছে হেকাটেউস লেখায় কাস্পাপাইরস বা হেরোডোটাসের লেখায় কাস্পাটাইরস নামে। টলেমি তাঁর লেখা কাশ্মীরকে ‘কাস্পেইরিয়া’ নামে নির্দেশ করেছেন।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে আসা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর লেখা জানতে পারা ‘কাশ-মি-লো’ রাজ্যের কথা যার অস্তিত্ব ছিল প্রথম শতাব্দী থেকে ।
১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে শিখ মহারাজা রণজিৎ সিংহ-এর কাশ্মীর বিজয়ের পূর্বে এখানে রাজত্ব ছিল পাশতুন উপজাতীয় দুরানী রাজবংশের। প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর লাহোর চুক্তি অনুসারে কাশ্মীর ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে আসে, যারা কিছুদিন পরেই অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে জম্মুর রাজা গুলাব সিং-কে বিক্রি করে দেয়, এর ফলে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরে মহারাজা উপাধি লাভ করেন। এইসময় থেকে ১৯৪৭-এ দেশভাগের আগে পর্য্যন্ত হিন্দু মহারাজাদের অধীনে কাশ্মীর শাসিত হয় যদিও জম্মু ও লাডাখ অঞ্চল ছাড়া সমগ্র রাজ্যে মুসলমান জনসংখ্যার আধিক্য ছিল বেশি। যদিও ভারতের জনসংখ্যা পাকিস্তানের পাঁচ গুণ বেশি তবে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় সমান।
কাশ্মীরের ইতিহাস বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশ ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের (মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়া) ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীরকে 'কাশ্মীর উপত্যকা' নামে অভিহিত করা হয়েছে। বর্তমানে কাশ্মীর বলতে একটি তুলনামূলক বৃহৎ অঞ্চলকে বোঝায়। বর্তমান ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য (যেটি জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখের সমন্বয়ে গঠিত), পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চলদ্বয় এবং চীন-নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিন ও ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট অঞ্চলদ্বয় বৃহত্তর কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত।
পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ববর্তী সময়ে কাশ্মীর প্রথমে হিন্দুধর্ম এবং পরে বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরবর্তীতে নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শৈব মতবাদের উত্থান ঘটে। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটে এবং শৈব মতবাদের প্রভাব হ্রাস পায়। কিন্তু তাতে পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর অর্জনসমূহ হারিয়ে যায়নি, বরং নবাগত ইসলামি রাজনীতি ও সংস্কৃতি এগুলোকে বহুলাংশে অঙ্গীভূত করে নেয়, যার ফলে জন্ম হয় কাশ্মিরি সুফিবাদের।
১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী কাশ্মীরে মুসলিম শাসন বজায় ছিল। এর মধ্যে মুঘল সম্রাটরা ১৫৮৬ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত এবং আফগান দুররানী সম্রাটরা ১৭৪৭ সাল থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ—শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের নিকট শিখরা পরাজিত হয়। এরপর অমৃতসর চুক্তি অনুসারে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের কাছে থেকে ক্রয় করেন এবং কাশ্মীরের নতুন শাসক হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তাঁর বংশধরগণ ব্রিটিশ রাজমুকুটের অনুগত শাসক হিসেবে কাশ্মীর শাসন করেন। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময় অঞ্চলটি একটি বিবদমান অঞ্চলে পরিণত হয়। বর্তমানে অঞ্চলটি ভারত, পাকিস্তান ও চিনের মধ্যে বিভক্ত।
সূত্র: উইকিপিডিয়া

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা? Detailed description of the murder of Sheikh Mujibur Rahman

বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা?

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকেসহ সপরিবারে হত্যার একটি ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বিপদগামী দল শেখ মুজিবের ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবনে অভ্যুত্থান সংঘটিত করে তাঁকে হত্যা করে। পরে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
#পটভূমি
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। তিনি পাকিস্তান থেকে ইংল্যান্ডের লন্ডন ও ভারতে গমন করেন। সেসময় বাংলাদেশ ভারতের অধিকারে ও নিয়ন্ত্রণে থাকে। দেশে ফেরার পর মুজিবকে প্রথমে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি অবিলম্বে সকল রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে জাতীয় ঐক্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালে অপ্রশমিত রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে একটি সাংবিধানিক সংশোধনীবলে বাহ্যত বিরোধী ছাড়া মুজিব রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত হন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের মাধ্যমে তাঁর এক দলের শাসনের ঘোষণার সাথে সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও সকল রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করে। মুজিবের একনায়কতন্ত্র ব্যাপক প্রহরতা ও বিচার বিভাগের অপব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত হয়। তেজস্বী দুর্নীতি এবং খাদ্য সরবরাহে ত্রুটি ও খাদ্যাভাবের ফলে সর্বনাশা দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হলে দেশ বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়। জাতীয়করণ কোনো বাস্তব অগ্রগতি সাধনে ব্যর্থ হয়। লরেন্স লিফশুলজ তাঁর "ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ" বইয়ে লিখেনযে বাংলাদেশীদের দুর্নীতি, অপকর্ম এবং জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের চিন্তা নজিরবিহীন ছিল।
জাতীয় রক্ষীবাহিনী ছিল ১৯৭২ সালে গঠিত একটি অত্যন্ত বিতর্কিত রাজনৈতিক মিলিশিয়া বাহিনী যা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অনুগত ছিল। এটি বেসামরিক জনগণের কাছ থেকে অস্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য গঠিত হলেও প্রকৃতপক্ষে মুজিবের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া থেকে রক্ষা করতে কাজ করে। জাতীয় রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষও মুজিবুরের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
#বামপন্থী শক্তির উত্থান
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে উদীয়মান বামপন্থী শক্তি মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য অনেকটা দায়ী। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকে বিভক্ত হয়ে একটি অংশ নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হয়।
কর্নেল আবু তাহের ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদের সশস্ত্র শাখা, গণবাহিনী সরকারের সমর্থক, আওয়ামী লীগের সদস্য ও পুলিশদের হত্যার মাধ্যমে অভ্যূত্থানে লিপ্ত হয়।এর ফলে দেশের আইন শৃঙ্খলার সম্পূর্ণ ভাঙ্গন ধরে এবং মুজিব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পথ প্রশস্ত করে দেয়।
#চক্রান্তকারীগণ
কর্নেল (সেই সময়ে মেজর) সৈয়দ ফারুক রহমান, খন্দকার আবদুর রশীদ, শরীফুল হক (ডালিম), মহিউদ্দিন আহমেদ, এ.কে.এম মহিউদ্দিন আহমেদ, বজলুল হুদা এবং এস.এইচ.এম.বি নূর চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মেজর ছিলেন। বিদেশি গোয়েন্দাদের থেকে ইঙ্গিত পেয়ে তাঁরা সরকারকে উৎখাত করে নিজেদের সামরিক সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে। মুজিবের মন্ত্রিপরিষদের আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণে সম্মত হন। তবে মোশতাক ও সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি চক্রান্তে জড়িত ছিল বলে সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ দাবি করেন।কথিত আছে, তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স এবং এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলাম খান মুজিব হত্যার চক্রান্ত সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
#ঘটনাপ্রবাহ
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরে ষড়যন্ত্রকারীরা চারটি দলে বিভক্ত হয়। এদের একদল ছিল মেজর হুদার অধীনে বেঙ্গল লেন্সারের ফার্স্ট আর্মড ডিভিশন ও ৫৩৫ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা যারা মুজিবের বাসভবন আক্রমণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানরত আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদদাতা সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তাঁর "মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা" বইয়ে লিখেন যে, মুজিব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত বর্ণনা সবসময় রহস্যে ঘনীভূত থাকবে। তিনি আরও লিখেন যে, মুজিবের বাসভবনের রক্ষায় নিয়োজিত আর্মি প্লাটুন প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করে না। মুজিবের পুত্র, শেখ কামালকে নিচতলার অভ্যর্থনা এলাকায় গুলি করা হয়। মুজিবকে পদত্যাগ করা ও তাঁকে এ বিষয়ে বিবেচনা করার জন্য বলা হয়। মুজিব সামরিক বাহিনীর প্রধান, কর্নেল জামিলকে টেলিফোন করে সাহায্য চান। জামিল ঘটনাস্থলে পৌঁছে সৈন্যদের সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলে তাঁকে সেখানে গুলি করে মারা হয়। মুজিবকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মুজিবের স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব (উপরের তলায় হত্যা করা হয়), মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসের, দুইজন চাকর (শৌচাগারে হত্যা করা হয়); শেখ জামাল, ১০ বছর বয়সী শেখ রাসেল এবং মুজিবের দুই পুত্রবধুকে হত্যা করা হয়।সেসময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। তাঁরা ভারত সরকারের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে ভারতে চলে আসেন। তিনি নির্বাসিত অবস্থায় দিল্লীতে বসবাস করতে থাকেন। তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ই মে বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তন করেন।
দুটি সৈনিক দল মুজিবের ভাগ্নে ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শেখ ফজলুল হককে(মনি)তাঁর অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রীর সাথে ১৩/১, ধানমন্ডিতে এবং মুজিবের ভগ্নিপতি ও সরকারের একজন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে তাঁর পরিবারের ১৩ জন সদস্যসহ মিন্টু রোডে হত্যা করে।
চতুর্থ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী দলটিকে সাভারে সংস্থিত নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত প্রত্যাশিত বিরোধী আক্রমণ ঠেকানোর জন্য পাঠানো হয়। একটি সংক্ষিপ্ত লড়াইয়ের পর এগারজনের মৃত্যু হলে সরকারের অনুগতরা আত্মসমর্পণ করে।
আওয়ামী লীগের চারজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, সাবেক উপ-রাষ্টপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামএবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আ হ ম কামারুজ্জামানকে আটক করা হয়। তিন মাস পরে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বরে তাঁদের সকলকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ হাইকোর্ট।
#হত্যাকাণ্ডের বিচার
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বা ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার এবং ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলা করেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল তৃতীয় বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২৫ দিন শুনানীর পর অভিযুক্ত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করেন৷
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত বাদী-বিবাদীর আপিলের প্রেক্ষিতে চার দফায় রায় প্রকাশ হয়, সর্বশেষ আপিল বিভাগ ২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর থেকে টানা ২৯ কর্মদিবস শুনানি করার পর ১৯ নভেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। রায়ে এরই মাধ্যমে ১৩ বছর ধরে চলা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের আইনি ও বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়।
#রায় কার্যকর
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয় তারা হলেন-
লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহম্মেদ (আর্টিলারি) ও লে. কর্নেল একেএম মহিউদ্দিন আহম্মেদ (ল্যান্সার)।
এছাড়ও এখনো ১২ জনের মধ্যে ছয়জন বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। পলাতকরা হলেন কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদ, লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল এএম রাশেদ চৌধুরী, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, লে. কর্নেল এসএইচ নূর চৌধুরী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আব্দুল মাজেদ।
॥॥॥
সূত্র : উইকি পিডিয়া 
সংগ্রহ : ফারুক হোসেন