ফেইল করার একটা ঘটনা শেয়ার করি।
.
সৈয়দ আবিদ হাসান
প্রশাসন ক্যাডার (৩৬ তম বিসিএস)
.
বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই ব্যাংক এশিয়াতে ভাইভা কল পেয়েছিলাম গত বছর। তখনও আমার মাস্টার্স শেষ হয়নি। তো, বেশ এক্সাইটেড হয়ে প্রিলিমিনারি ভাইভাতে অংশ নিলাম এবং প্রথম ধাপ উত্তীর্ণ হলাম। এরপরে ছিল এমডি ভাইভা; মানে আসল পরীক্ষা। যেদিন ভাইভা তার জাস্ট এক দিন আগে মেসেজ পেলাম। বাবা আর মা তখন কলকাতায়। বাবার চোখের অপারেশন ছিল সেদিন। ভাইভা বিকাল চারটায়। আমি বাসায় একদম একা। কোন মতে প্রস্তুতি নিয়ে বের হলাম। ভাইভা দিতে গিয়ে জানলাম আমার মেরিট পজিশন ১৪, আর MTO নেয়া হবে ৩০ জনের মতো; মানে সম্ভাবনা অনেক বেশি! এটা জেনে টেনশনটা আরও বেড়ে গেলো! কিন্তু, আশেপাশে সবাইকে দেখে কিছুটা হতাশ হলাম। প্রত্যেকে কালো বা ডার্ক নেভি ব্লু ক্লালারের ব্লেজার পরেছে। তিনজন মেয়ে ছিল; তাদের দুই জন শাড়ি পরেছে। তারা যেভাবে কথা বলছিল তাতে তাদের প্রিপারেশনের ধার বেশ বুঝতে পারছিলাম। আমরা যখন ভাইভার জন্য অপেক্ষা করছি তখন HR হেড স্যার আসলেন। কিছু ইন্সট্রাকসন দিলেন; যেমন কেউ যেন ফাইল বা ব্যাগ হাতে নিয়ে ভাইভা রুমে না ঢোকে; ফোনটা যেন সাইল্যান্ট থাকে ইত্যাদী। এরপর উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আপনি ব্লেজার পরেননি কেন?" আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম! গরমকালে ব্লেজার পরাটা এতো জরুরী এটাতো আমি ভাবিনি! আমতা আমতা করে বললাম, "স্যার, আমার ব্লেজার নেই" ; স্যার ধমকে বললেন, "নাই তো ম্যানেজ করতে পারলেন না?" আমি বললাম, "স্যার স্যরি, আমি ম্যানেজ করতে পারিনি।" স্যার খুব কঠিনভাবে বললেন, "It will not give you a good impression" বলেই চলে গেলেন। আমি উপস্থিত ক্যান্ডিডেটদের কাছে ধার চাইলাম। কেউ রাজী না। তবে, একজন রাজী হলেন। সুদীপ কর্মকার দাদার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। উনার সিরিয়াল ছিল ১৬। উনি রাজী হলেন উনারটা দিতে। ঠিক হলো আমি উনার ব্লেজার পরে ১৪ নম্বর পজিশনে ভাইভা দিয়ে আসবো। ১৫ নম্বর যখন ঢুকবে তখন আমি উনাকে ব্লেজার দিয়ে দেবো। বেচারা অতি শুকনা মানুষ। তার ব্লেজার আমার টাইট হচ্ছে খুব। কি আর করা। তো, ভাইভা বোর্ডে ঢুকলাম। আমাকে প্রথমেই ডিএমডি স্যার বললেন, "তোমার টাই এর নট ঠিক নেই; তুমি খেয়াল করো নাই এইটা?" আমি বললাম, "Sorry sir, I am not much habituatted with this attire." ভাইভা বোর্ডে ঢোকার আগে একবার ওয়াশরুমে গিয়ে টাই এর নট ঠিক করে আসা উচিৎ ছিল; মারাত্মক ভুল করেছি! এদিকে ব্লেজারটাও যে একেবারে ফিট করেনি সেটা বুঝাই যাচ্ছে। নার্ভাস ছিলাম সব মিলিয়ে। জানা প্রশ্নগুলোও পারলাম না উত্তর দিতে। ভাইভা বোর্ডেই বুঝতে পারলাম যে, আমি নিশ্চিত ফেইল করছি। ইনফ্যাক্ট, প্রশ্নের উত্তর পারলেও লাভ হতো না এই যাচ্ছেতাই গেট আপের কারণে।
সেদিন বাসায় এসে আমার মনের অবস্থা কেমন ছিল সেটা ভাষায় বর্ণনা করার মতো শব্দ আমার ভাণ্ডারে নাই। বাসায় একা ছিলাম। রাতে খাইনি কিছু আর। কাপড়টা চেঞ্জ করতেও ইচ্ছে করছিল না। ঝিম মেরে বসে শুধু ভাবছিলাম, "ব্লেজার পড়তে হবে এটা জানি না; টাই এর নট পারি না... আমি কি সত্যিই এতো ক্ষ্যাত? এই অবস্থা নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে ক্যারিয়ার গড়ার?" তবে এরপর, যা যা প্রস্তুতি নেয়া দরকার নিয়েছি। টাই এর নট শিখলাম ইউটিউব দেখে। তাও কনফিডেন্স পাই না। তাই এক এক্সপার্ট ফ্রেন্ডকে দিয়ে দুইটা টাই ঠিকঠাক নট দিয়ে রেখেছি। নিউমার্কেটে গিয়ে কম দামে ব্লেজার কিনে নিলাম। দুই তিন মাস পরে একটা ভাইভা দেয়ার জন্য বেশি দামী ব্লেজারতো দরকার নেই। শার্ট, প্যান্ট সবই বানিয়ে রাখলাম। এক সেট থাকলেইতো হলো। আর এর সাথে শুরু করলাম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপের চোখ রাখা। কোথাও কেউ কোন ভাইভা এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করলেই সেটা পড়ে ফেলতাম। রিটেনে ফেইল করলে আলাদা হিসাব কিন্তু ভাইভাতে আর বাদ পড়া যাবে না।
এরপরে অবশ্য আর ফেইল করিনি। আমার মনে হতো পারলে রিটেন এক্সামও ব্লেজার পরে দিয়ে আছি

১। ছেলেরা ক্লিন শেভ করলে ভাল। যদি দাড়ি রাখতে চান তাহলে অন্তত ট্রিম করে যাবেন। তবে, কিছু কিছু বোর্ড দাড়ি মোটেই পছন্দ করে না। তাই ক্লিন শেভ করে যাওয়া বেটার। আর ধর্মীয় কারণে দাড়ি রাখলে সম্পূর্ণ আলাদা ইস্যু। ব্যাংকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারে যে, আপনি তাহলে ব্যাংকে কেন আসবেন? এক্ষেত্রে যথাযথ উত্তর তৈরি রাখবেন। আর সেধরনের ইস্যু না থাকলে ক্লিন শেভ সব দিক থেকে সেফ।
২। সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট হচ্ছে বেস্ট অপশন। সাদা শার্টে চেক থাকতে পারে তবে সেটা Vertical Stripe, দাবার কোটের মতো বক্স না এবং Horizontal stripe না। এবং চেকটাও যেন খুব সরু চেক হয়। নিজের কমোন সেন্স ইউজ করে দেখবেন যে কোনটায় বেশি ফর্মাল লাগে। আর শার্টের কালারের ক্ষেত্রে হালক কালার সিলেক্ট করবেন। সাদা, আকাশী নীল, ছাই রঙ এর বাইরে না যাওয়াই ভাল। গোলাপী ধরণের রঙ আপনার পছন্দ হলেও বোর্ড পছন্দ না করতে পারে। কিন্তু, যে কয়েকটা রঙ বললাম এগুলো সব বিতর্কের বাইরে।
৩। টাই এর কালারটা দুই রঙ্গা হলে ভাল, এক রঙ্গাও ভালো তবে তিন রঙ্গা না হওয়া বেটার। আর প্যান্টের কালারের সাথে ম্যাচিং থাকলে ভাল। ধরুন আপনার প্যান্ট কালো রঙ্গের, সেক্ষেত্রে টাই হতে পারে মেরুন ও কালো রঙ্গের। মনে রাখবেন হালকা কালারের শার্টের সাথে ডার্ক কালারের টাই, ব্লেজার ও প্যান্ট হচ্ছে পারফেক্ট।
৪। কর্পোরেট লেভেলে ভাইভা দিতে গেলে ব্লেজার কতোটা জরুরী সেটা আশা করি আমার এই ফেইল করার ঘটনা থেকে বুঝতে পেরেছেন। অনেকে অ্যাশ কালারের ব্লেজার পরে যান। তবে, ব্যাংক এশিয়ার মতো কিছু প্রতিষ্ঠান কালো রঙ্গের বাইরে কিছুই পছন্দ করে না। কাজেই, নিরাপদ হচ্ছে কালো রঙ্গের ব্লেজার।
৫। শু পড়বেন অবশ্যই এবং পরিষ্কার রাখবেন। মধুমতি ব্যাংকে ভাইভা দিতে গিয়ে রাস্তায় আমার জুতা কাদায় মাখামাখি অবস্থা। দোকানে গিয়ে এক প্যাকেট টিস্যু কিনে ব্যাংকে ঢুকেই আগে ওয়াশরুমে গেলাম। তারপর ১৫ মিনিট ধরে শুধু জুতাই পরিষ্কার করেছি। ওই অবস্থায় ভাইভা বোর্ডে ঢুকলে হয়তো ঢোকা মাত্রই বের করে দিতো!
৬। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু হচ্ছে ব্লেজারের বোতাম লাগানো। চেষ্টা করবেন Two Button ব্লেজার পরতে। নিয়মটা হচ্ছে যখন আপনি দাঁড়িয়ে তখন দুইটা বাটন লাগানো থাকবে আর যখন বসবেন তখন নীচের বাটোন খোলা থাকবে। তো, এসব ঝামেলা না করে শুধু উপরেরটা লাগিয়ে আর নীচেরটা খোলা রেখে ঢুকে পরাই সহজ আমার মতে। আমি তাই করেছি।
৭। ব্যক্তিগত জীবনে আপনি যত স্টাইলিস্টই হন না কেন, ভাইভার আগে চুলটা ছোট না রাখলে সমস্যা।
এতো গেলো ছেলের ব্যাপার। মূলত এই ফর্মাল ড্রেসের যন্ত্রণা ছেলেদেরই বেশি। মেয়েদের ড্রেস-আপের ব্যপারে আমার ধারণা স্বাভাবিকভাবেই কম; তবে যতটুকু শুনেছি, মেয়েদের ক্ষেত্রে শাড়ী পরলে খুব ভাল হয়। না পড়লেও ক্ষতি নেই। তবে, শুনলাম ব্যাংক এশিয়ার ডিএমডি স্যার আমাদের এক ফ্রেন্ডকে সরাসরি বলেছিলেন জামদানি শাড়ি পরে আসতে। যাইহোক, ডিসেন্ট ড্রেস আপ করে যাওয়ার ব্যপারে বেশি পরামর্শ দেয়ার কিছু নেই। এই ব্যপারে মেয়েরা যথেষ্ট জ্ঞান রাখে বলেই মনে করি। তারপরও ব্যাংকে চাকরী করছে, এমন কোন আপু থাকলে তার কাছে হেল্প নিতে পারেন।
খারাপ অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। শেষ করছি ভাল অভিজ্ঞতা দিয়ে। ব্যাংক এশিয়ার সেই ঘটনার পর ভাইভার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম ধুমায়ে। অন্য সব পড়া ফেলে ভাইভার প্রস্তুতি নিতাম। ফলাফলও পেয়েছি। মধুমতিতে ভাইভা পারফর্ম্যান্সের বিচারে আমাকে দেয়া হয়েছিল হেড অফিসের কর্পোরেট ডিপার্টমেন্টে। আমার ডিপার্টমেন্টের হেড জানিয়েছিলেন যে ভাইভাতে টপ তিন জনের মধ্যে আমি একজন, তাই আমাকে এই ডিপার্টমেন্টে দেয়া হয়েছে! যদিও জবটা ছেড়েছি নানা কারণে। ওয়ান ব্যাংকে অবশ্য অন্য হিসাব। এখানে প্রথম বছরে কাউকেই হেড অফিসে দেয়া হয় না। তবে, জানতে পেরেছি যে এখানে ভাইভা পারফর্ম্যান্সে টপারদের মধ্যেই আছি; এক্স্যাক্ট পজিশনটা জানতে পারিনি অবশ্য। তবে যেটাই হোক, আত্মবিশ্বাসটা অবশেষে ফিরে আসলো। কিছু কিছু ফেইলিয়র হয়তো অনেক সফলতার দরজা খুলে দেয়। আর একটা মজার ব্যপার বলি। মানুষকে সাহায্য করলে ঈশ্বর হাতেনাতে পুরষ্কার না দিলেও একটা সময় ঠিকই দেন। বলেছিলাম না, ব্যাংকে এশিয়াতে সুদীপ কর্মকার দাদা উনার ব্লেজারটা আমাকে দিয়েছিলেন? ঐ রিক্রুইটমেন্টে আমার আর সুদীপ দাদার কারোরই জব হয়নি। কিন্তু, ঘটনাচক্রে আমরা দুইজনই এখন ওয়ান ব্যাংকে স্পেশাল ক্যাডার অফিসার (MTO)!
আজ এ পর্যন্তই। ভাল থাকুন সবাই।
.
#Courtesy
অমিত বাগচী (দাদা)
-স্পেশাল ক্যাডার অফিসার, ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড
No comments:
Post a Comment