Sheikh Hasina's contribution is unforgettable - শেখ হাসিনার অবদান অবিস্মরণীয়

শেখ হাসিনার অবদান অবিস্মরণীয় - Sheikh Hasina's contribution is unforgettable

ডাঃ কামরুল হাসান খান

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চার চারবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় চার দশকে উপমহাদেশের অন্যতম, ঐতিহ্যবাহী, রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে তিনি কখনও দেশের প্রধানমন্ত্রী, কখনও বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং কখনও রাজপথের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। যখন যে অবস্থায় থাকুন না কেন দেশের এবং দেশের কল্যাণের কথাই ভেবেছেন, প্রয়োজনে বহুবার জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ নিয়েছেন। ১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর, কণ্টকাকীর্ণ পথ, ঢেউয়ের সাগর। হয়েছেন গৃহবন্দী, খেটেছেন জেল-জুলুম, সইতে হয়েছে নানা ধরনের নির্যাতন। জননেত্রীর লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তবায়ন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে দলকে, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন যুগ যুগ ধরে বাংলার পথে-প্রান্তরে। ১৯ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরাধিকারী, স্বপ্ন বাস্তবায়নকারী শেখ হাসিনাকে, নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে, ’৭৫-এর ধারায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরতরে রুদ্ধ করতে। জননী-সাহসিকা-নির্ভীক জননেত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে চলেছেন শত বাধাবিপত্তি-ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে। তাঁর ভাবনা শুধু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন, বাবার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করা, দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণ। দলের ভেতরে-বাইরে, জাতীয়-আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বত্রই ষড়যন্ত্র এবং পিচ্ছিল পথ। এর মধ্যেই দেশের কল্যাণের কথা ভেবে, দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে, দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। প্রয়োজনে তিনি বহুবার বৈরী শক্তির সঙ্গেও বসেছেন গণতন্ত্রের জন্য, দেশের মানুষের সুন্দর জীবনের জন্য, বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। এর জন্য তাঁকে জীবনের সকল ঝুঁকি নিতে হয়েছে, কখনও কখনও হতে হয়েছে অসম্মানিত আর ষড়যন্ত্রের শিকার। তিনি অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছেন বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, উন্নত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য; যা জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার কিছু এখানে উল্লেখ করছি-

১) ২১ বছর পর দলের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন : ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর পর্বতপ্রমাণ প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করে হতাশ, পর্যুদস্ত, বিক্ষিপ্ত, বিভক্ত দলকে ঐক্যবদ্ধ করে নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। বিশ্বের ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা।

২) চার বারের প্রধানমন্ত্রী : একজন রাজনৈতিক নেতার চারবার নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হওয়া বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। অনেক আগেই বিশ্বের শক্তিধর নারীনেত্রী যুক্তরাজ্যের মার্গারেট থ্যাচার, ভারতের শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীলঙ্কার মিসেস কুমারাতুঙ্গার রেকর্ড অতিক্রম করেছেন। এখনও তিনি দেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। পাশাপাশি নিজের দলকেও টানা তিনবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এনেছেন। তাঁর কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী অর্জন করেছেন নানা সম্মাননা, উপাধি এবং পুরস্কার যার সংখ্যা প্রায় ৩৯।

৩) সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণ : ১৯৯১ সালের নির্বাচনে কারচুপির ভোটে হেরে গেলেও ১৯৯১ এর সংসদে নিজে উদ্যোগ নিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। এর জন্য তাঁকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বসতে হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া-এরশাদ পাকিস্তানী ধারায় রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার চালু করে। শেখ হাসিনার উদ্যোগে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসায় স্বৈরাচারী সরকার পদ্ধতির অবসান ঘটে ।

৪) স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রধান নেতৃত্ব দান : স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধান শক্তি ছিল তাঁর দল আওয়ামী লীগ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হয় আওয়ামী পরিবারকে। এ আন্দোলনের জন্য তিনি বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল প্রগতিশীল দলের সঙ্গে আলোচনা করেন। বিভিন্ন জোটের প্রধান নেতা হিসেবে তিনি গণঅভ্যুত্থান ’৯০ সংঘটিত করেন।

৫) বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: একটি দলীয় সরকারে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন ’৯০ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি দেশের মানুষের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করেছিলেন, যার সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল। পরিণতি কি হয়েছিল তা দেশের মানুষ ওয়াকিফহাল।

৬) পদ্মা বহুমুখী সেতু : শেখ হাসিনার নেতৃতে বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় মাইলফলক হচ্ছে পদ্মা সেতু নির্মাণ। মিথ্যা অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প বাতিল করে দিয়ে শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশকে চাপের মুখে ফেলে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ভেঙ্গে পড়ার মানুষ নন। সিদ্ধান্ত নিলেন নিজস্ব উদ্যোগে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবেন। আজ পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আশা করা হচ্ছে আগামী বছর চালু করা হবে। পরবর্তীতে কানাডার আদালতেই অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপের জন্য শেখ হাসিনা সরকার এবং বাংলাদেশ দুটোরই বিশ্বে মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে উন্মোচিত হবে দক্ষিণ বাংলার অর্থনীতিসহ উন্নয়নের সকল দুয়ার, আরও শক্তিশালী হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত।

৬) পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি : সুদীর্ঘ দুই দশকের অধিক সময় ধরে চলে বাংলাদেশের ভূস্বর্গ পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংঘাত, বিদ্রোহ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যা। পরিণত হয় এক অশান্ত বিরান ভূমিতে। ১৯৯৬ সালে সরকারে দায়িত্ব গ্রহণ করে উদ্যোগ নেন এ পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধানের। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় স্থায়ী সমাধান এবং শান্তি।

৭) শেখ হাসিনার উন্নয়নের ভিশন : ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি ইশতেহারে যুক্ত করেন নতুন উন্নয়ন ও বাংলাদেশের আধুনিকায়নের ধারা ‘রূপকল্প ২০২১’, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বা ‘দিন বদলের সনদ।’ ২০২১ এর অনেক আগেই রূপকল্পের অধিকাংশ কর্মসূচী বাস্তবায়ন হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে তখন তিনি ২০১৪’র নির্বাচনের ইশতেহারে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা নিয়ে ঘোষণা দিলেন ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।’ ২০১৮’র নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করলেন ‘সমৃদ্ধি যাত্রায় বাংলাদেশ’ যার মধ্যে গ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রাধান্য পেল- গ্রামে যাবে শহরের সুবিধা। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল। তিনি ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন ‘উন্নত বাংলাদেশ ২০৪১’ এবং ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের মানুষের জন্য উন্নয়নের মহাসড়ক বানিয়ে দিয়েছেন। এখন সকলের দায়িত্ব এ ধারাকে অব্যাহত রেখে উন্নত বাংলাদেশে পৌঁছে যাওয়া।

৮) বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার : বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবে না। জাতির পিতাকে হত্যাকারীদের বিচারের জন্য দেশের মানুষ কষ্ট নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। অনেকেই ব্যথা নিয়ে বলেছেন, মৃত্যুর আগে যদি বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারটা দেখে যেতে পারতাম। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশবাসীর সেই আকাক্সক্ষা পূরণ করেছেন। মহান জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বাধা ইনডেমনিটি বিল বাতিল করে আইনের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী শেখ হাসিনা জাতির পিতার হত্যার বিচারের ব্যবস্থা করেছেন। জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।

৯) যুদ্ধাপরাধীদের বিচার : শহীদ-লাঞ্ছিত পরিবারসহ দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আকাক্সক্ষা এবং দাবি ছিল একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ’৭২ সালেই আইন প্রণয়ন করে তাদের বিচার শুরু করেছিলেন এবং অনেকটাই করে ফেলেছিলেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর স্বাধীনতাবিরোধী জিয়া সরকারে এসে সে বিচার বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ এ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারে এসে সে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। কঠিন বাধাবিপত্তি এবং আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে তিনি নিজামী-মুজাহিদ-সাকা চৌধুরীসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়ন করেন।

১০) জেল হত্যার বিচার : ১৯৭৫’র ৩ নবেম্বর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহচর জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, মোঃ কামরুজ্জামানকে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনা হত্যাকারীদের বিচার কাজ সম্পন্ন করেছেন।

১১) উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার রাতে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) পাঁচ দিনের বৈঠক শেষে এ সুপারিশ করেছে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যে কোন দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। ২০১৮ সালে প্রথম দফায় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার যোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এবারও প্রথমবারের মতো তিনটি সূচকেই প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করেছে।

১২) মেগা প্রকল্প : মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশকিছু মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন, ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণের বিপুল কর্মকান্ড দ্রুত এগিয়ে চলেছে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি পরিকল্পনা ও তত্ত্ব¡াবধানে।

(চলবে)

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

No comments:

Post a Comment