নীল নদ নিয়ে যুদ্ধের মুখোমুখি মিশর ও ইথিওপিয়া (বিস্তারিত)
নীল নদের শাখা নদী ব্লু নাইলে ড্যাম (বাধ) তৈরি করছে ইথিওপিয়া। এটা নিয়ে যুদ্ধের মুখোমুখি দুটি দেশ। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ সিসি জনগনের উদ্দেশ্য বলেন, নীল নদ থেকে কেউ এক ফোটা পানিও নিতে পারবে না। অন্যদিকে ইথিওপিয়ার আবি আহমেদ বলেছেন, কোন শক্তিই ইথিওপিয়াকে বাঁধ নির্মাণ থেকে দমাতে পারবে না। সিসির মতে ইথিওপিয়া এই বাঁধ বানালে তাদের অস্তিত্ব সংকট দেখা দেবে। বুঝতেই পারছেন বিষয়টি কত সিরিয়াস দুটি দেশের জন্য। আসুন বিস্তারিত জেনে নিই আসলে কি নিয়ে দুটি দেশ যুদ্ধের মুখোমুখি!!!
★গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাধ★
আপনারা মানচিত্রে তাকালে দেখবেন যে নীল নদের দুটি শাখা নদী রয়েছে একটা হোয়াইট নাইল (White Nile), অন্যটা ব্লু নাইল(Blue Nile)। এই ব্লু নাইল ইথিওপিয়ার তানা হ্রদ থেকে উৎপন্ন হয়ে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সুদানে প্রবেশ করেছে। দুইটি উপনদী সুদানের রাজধানী খার্তুমের নিকটে মিলিত হয়েছে। জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্য নীল নদের শাখা নদী ব্লু নাইলের ওপর এই বিশাল বাঁধ তৈরি করছে ইথিওপিয়া। যার নাম দিয়েছে গ্র্যান্ড রেনেসাঁ ড্যাম। এই বাঁধ তৈরি নিয়ে মিশর এবং ইথিওপিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিলো।
★চুক্তি মানতে নারাজ ইথিওপিয়া★
ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলে নীল নদের উৎস নদী ব্লু নীলে ২০১১ সালে বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু করে ইথিওপিয়া যেখান থেকে নীল নদের ৮৫ শতাংশ পানি প্রবাহিত হয়। ইথিওপিয়া পরিকল্পিত এই বাঁধটি নির্মিত হলে সেটা হবে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ১৯২৯ সালে মিশর ও তৎকালীন আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেন একটি চুক্তি হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালের আরেকটি চুক্তি হয়, সেই চুক্তিতে মিশর এবং সুদানকে নীল নদের সমস্ত পানির উপর অধিকার দেয়া হয়। ঔপনিবেশিক আমলের সেসব নথিপত্রে নদীটির উজানে যে প্রকল্প পানি প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে, সেখানে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয় মিশর ও সুদানকে। ইথিওপিয়া বলছে, শতবর্ষ পুরনো ওসব চুক্তি মানতে তারা বাধ্য নয় এবং ২০১১ সালে আরব জাগরণের পরপরই তারা বাঁধের কাজকর্ম শুরু করে। মিশরের দাবি, ১৯৫৯ সালের জলচুক্তি মেনে চলতে হবে। সেই চুক্তিতে নীল নদের জলের সব চেয়ে বেশি অংশ মিশরকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইথিওপিয়া সেই চুক্তির শরিক ছিল না। ইথিওপিয়া দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে চেয়েছে। কিন্তু মিশর ১৯৫৯ এর চুক্তি থেকে সরে আসতে রাজি নয়। ইথিওপিয়ার লোক এই বাঁধ বানাবার পক্ষে। তাঁদের দাবি, এটা তাঁদের অধিকার। কারণ, তাঁরা নিজের দেশে বাঁধ তৈরি করছেন।এই অবস্থায় মিশর চাইছে, জলবন্টন নিয়ে আইনত ব্যবস্থা হোক। ব্লু নাইলের নাব্যতা বজায় রাখার ব্যবস্থা হোক। সম্প্রতি তিন দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসার সম্ভাবনা ভেস্তে যাওয়ার পর মিশরের আপত্তিতে কান না দিয়ে বাঁধের কাজ আবার শুরু করে দিয়েছে ইথিওপিয়া। আর তাই নিয়ে তিন দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। শুরু হয়েছে প্রতিবাদ।
★কেন এ নিয়ে এতো বিবাদ?★
১. এই বিতর্কের মুল কেন্দ্রে রয়েছে গ্র্যান্ড রেনেসাঁ বাঁধ যা নিয়ে মিশরের আশঙ্কা যে, এর ফলে ইথিওপিয়া নীল নদীটির পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।
২. মিশর মনে করছে ইথিওপিয়ার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে নদীটির স্রোত প্রবাহের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। পানির জন্য নীল নদের ওপর ৯০ ভাগ নির্ভর করে মিশর।
৩. নীল নদে যদি পানি প্রবাহ কমে যায়, তাহলে সেটি মিশরের লেক নাসেরকে প্রভাবিত করবে। যার ফলে মিশরের আসওয়ান বাঁধে পানির প্রবাহ কমে যাবে, যেখান থেকে মিশরের বেশিরভাগ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। ফলস্বরূপ মিশরের বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে।
৪. মিশরের আরো আশঙ্কা, ইথিওপিয়ার বাঁধের কারণে নীল নদের পানির প্রবাহ যদি অনেক কমে যায়, তাহলে সেটি দেশটির নদীপথে পরিবহন ব্যবস্থাকেও হুমকির মুখে ফেলবে এবং কৃষকদের কৃষি ও পশুপালনের ওপর প্রভাব ফেলবে। কয়েক বছর পর কৃষি কাজের জন্য মিশর আর পানি পাবে না।তাই মিশরের কৃষকরাও অনেক ক্ষুব্ধ।
৫. মিশরও বলছে, তারা পুরোপুরি নীল নদের জলের ওপর নির্ভরশীল এবং জল যেহেতু কমছে, তাই ১০ কোটি লোকের জীবনের ওপর বিশাল প্রভাব পড়বে। গত মাসেই মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, জতি সংঘ হস্তক্ষেপ না করলে সংঘাত অনিবার্য। বাঁধ হলে মিশর ও সুদান মিলিয়ে ১৫ কোটি লোকের জীবন বিপন্নহয়ে যাবে। তাই এই বাঁধ তারা মানবে না।
★কেন এতো বড়ো বাঁধ তৈরি করতে চায় ইথিওপিয়া?★
১. প্রায় চারশো কোটি ডলার খরচ করে বাঁধটি তৈরি করতে চাইছে ইথিওপিয়া। এটি নির্মাণ শেষ হলে প্রায় ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।ইথিওপিয়ায় বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। দেশটির ৬৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী এখনো বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে বাস করে। এই বাঁধ থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে, তা দেশটির নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোকেও রপ্তানি করা যাবে। একদিকে নিজ দেশের চাহিদা পূরণ অন্যদিকে অন্য দেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন।
২. নিজেদের সক্ষমতার একটি প্রতীক হিসাবেও এই বাঁধকে দেখতে চায় ইথিওপিয়া।এই বাঁধ তৈরিতে বাইরের অর্থায়ন নিচ্ছে না দেশটি। সরকারি বন্ড এবং প্রাইভেট ফান্ড থেকে বাঁধটি তৈরি করা হচ্ছে।ফলে এই বাঁধের ব্যাপারে অন্য দেশের কথা বলাকে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ বলে মনে করছে ইথিওপিয়া।
৩. ইথিওপিয়া বলছে, তাদের ১১ কোটি লোকের দারিদ্র্য ঠেকাতে এই বাঁধ অত্যন্ত জরুরি। এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়ে গেলে ইথিওপিয়া হবে আফ্রিকার সব চেয়ে বড় বিদ্যুৎ রপ্তানিকারী দেশ।
★ইথিওপিয়া ছাড়া আর কোন দেশ কি উপকৃত হবে?★
প্রতিবেশী সুদান, দক্ষিণ সুদান, কেনিয়া, জিবুতি এবং ইরিত্রিয়া এই বাঁধ থেকে উপকৃত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর অনেক দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সুদান হলো মিশরের বন্ধু ও ইথিওপিয়ার শত্রু। সুদানের জন্য একটি সুবিধা হলো যে, এই বাঁধের কারণে সেখানকার নদীর পানি প্রবাহ সারা বছর ধরে একই রকম থাকবে। কারণ সাধারণত অগাস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে পানি প্রবাহ বেড়ে গিয়ে অনেক সময় বন্যা দেখা দেয়। সুদানের লাভ হওয়া সত্ত্বেও সুদান কেন এই বাধের বিরোধিতা করছে? প্রথমতঃ মিশরের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে, দ্বিতীয়তঃ সুদান মনে করছে নীল নদের পানির উপর ইথিওপিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে সেটা হবে সুদানের জন্য হুমকিস্বরূপ।
★বিতর্ক কি যুদ্ধে গড়াতে পারে?★
আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, এই বিতর্কের সমাধান না হলে দেশগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। মিশরের ইকোনমি সম্পূর্ণ নীল নদের উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে গৃহ যুদ্বের কারনে ভঙ্গুর অর্থনীতি কাটিয়ে উঠতে এই বাধ ইথিওপিয়ার জন্য সত্যি জরুরি। ২০১৩ সালে গোপন ভিডিওতে দেখা যায় যে, বাঁধ তৈরি কেন্দ্র করে ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে একগাদা বৈরি পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব করছে মিশরের রাজনৈতিকরা। ২০১৮ সালের দিকে মিশর ও সুদান ইরিত্রিয়ায় মিলিটারি পাঠিয়েছিলো এই বাঁধ ধ্বংস করতে কিন্তু পারেনি। মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসি বলেছেন, নীল নদের পানি নিয়ে তাদের অধিকার রক্ষায় মিশর সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ গত বছর সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, বাঁধ নিয়ে দেশগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রও জড়িত হয়েছে এতে। যুক্তরাষ্ট্রের এতে জড়িয়ে পড়া থেকে বোঝা যায় যে, পরিস্থিতি কতখানি গুরুতর এবং অচলাবস্থা ভাঙ্গা কতটা জরুরি। এই অচল অবস্থা কাটাতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চেয়েছে মিশর, যা প্রথমে মানতে চায়নি ইথিওপিয়া। তবে পরে রাজি হয়েছে।যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দুইটি দেশের মধ্যে সংঘর্ষ হলে সেটি লাখ লাখ মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এর ফলে সুয়েজ খাল, হর্ন অফ আফ্রিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথও ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এই সিচুয়েশনে বিরোধ কীভাবে মিটবে তার কোনো সঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছে না।
তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে - Inside History, Start here Al Jazeera, বিবিসি বাংলা,Middle East Eye, CNN Africa
Muhammad Miraj Mia
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments:
Post a Comment